Saturday, November 7, 2015

একসঙ্গে একাধিক কাজ নয়: অ্যারিয়ানা হাফিংটন

গ্রিক-আমেরিকান লেখক ও কলামিস্ট অ্যারিয়ানা হাফিংটনের জন্ম ১৯৫০ সালের ১৫ জুলাই। অ্যারিয়ানা অনলাইন নিউজপোর্টাল হাফিংটন পোস্ট-এর সম্পাদক। তিনি ২০১৩ সালে স্মিথ কলেজের সমাবর্তনে এই বক্তব্য দেন।
অ্যারিয়ানা হাফিংটনঅভিনন্দন তোমাদের সবাইকে। সমাবর্তন বক্তাদের কাছ থেকে সবাই ‘সফল হওয়ার সহজ উপায়’-জাতীয় কিছু উপদেশ আশা করে। কিন্তু তার বদলে আমি চাইব সাফল্যের সম্পূর্ণ ধারণাটিকেই তোমরা ভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করো। আজকের পৃথিবীতে এটিই প্রয়োজন। শুধু শীর্ষ স্থান দখল করে বসে থাকলে হবে না, যেখানে আছো, সে স্থানটিকে বদলে দাও, পৃথিবীকে বদলে দাও। 
আমাদের সমাজে সাফল্য বলতে প্রধানত দুটো জিনিসকেই বোঝানো হয়: অর্থ ও ক্ষমতা। এমনকি সাফল্য, অর্থ ও ক্ষমতা—এই তিনটি শব্দ আজকাল প্রায় সমার্থক হয়ে পড়েছে। কিন্তু অর্থ ও ক্ষমতার বাইরেও আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। আমরা এমন সাফল্য চাইব, যার মধ্যে থাকবে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, জ্ঞান ও বিবেক, জীবনের প্রতি কৌতূহল ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা। শুধু অর্থ আর ক্ষমতা দুই পায়ের একটি টুলের মতো, এর ওপর ক্ষণিকের জন্য ভারসাম্য বজায় রাখা যায় কিন্তু একসময় তুমি ঠিকই উল্টে পড়বে। অসংখ্য সফল মানুষ এভাবেই উল্টে পড়েছেন, এখনো পড়ছেন। সাফল্যকে আমরা যেভাবে এত দিন ব্যাখ্যা করে এসেছি, তা আর গ্রহণযোগ্য নয়। সময় এসেছে জীবনকে নতুন চোখে দেখার। 
সফল হওয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের যতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তার পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলছে। নারীদের জন্য এই মূল্য আরও বেশি। যেসব নারী কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকেন, তাঁদের হূৎপিণ্ডের সমস্যায় ভোগার আশঙ্কা শতকরা ৪০ ভাগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এ শতাব্দীর কর্মজীবীরা, মানে তোমাদের মতো এত চাপ অতীতের কোনো প্রজন্মই মোকাবিলা করেনি। এই মুহূর্তে আমেরিকার অফিসগুলো কাজের চাপে বিধ্বস্ত, নির্ঘুম রাত কাটানো মানুষদের দিয়ে চলছে। ২০০৭ সালে আমার অবস্থাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। নিদ্রাহীন, পরিশ্রান্ত শরীরে আমি ডেস্কের ওপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার মাথায় আঘাত লেগেছিল, গালের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, ডান চোখের ওপর চারটা সেলাই দিতে হয়েছিল। নিদ্রাহীনতা যে শুধু শরীরের ক্ষতি করে তা নয়, এর ফলে তোমার সৃজনশীলতা, কর্মদক্ষতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা—সবকিছুতেই প্রভাব পড়ে। 
নিউইয়র্কে হাফিংটন পোস্ট-এর অফিসে দুটো রুম আছে শুধু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। প্রথম প্রথম আমাদের সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকৌশলীদের কেউই রুমগুলো ব্যবহার করতে চাইতেন না। তাঁরা ভাবতেন অন্যরা মনে করবেন কাজ ফাঁকি দিয়ে অফিসে এসে ঘুমানো হচ্ছে! অতঃপর আমরা অফিসের পরিবেশটা এমনভাবে বদলে ফেলেছি, যাতে বিশ্রাম নেওয়া নয়, বরং বিধ্বস্ত শরীরে হেঁটে বেড়ানোকেই বাঁকা চোখে দেখা হয়। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে এখন রুম দুটো খালি পাওয়াই মুশকিল! 
সাফল্যের সংজ্ঞায় সুস্থতাকে যোগ করার অর্থ হলো, জীবনে আর্থিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মানুষ হিসেবে আমাদের মানবিক চাহিদাগুলোর দিকেও নজর দেওয়া। আমার মা এই কাজটি খুব ভালো পারতেন। আমার বয়স যখন ১২, একদিন অত্যন্ত সফল এক ব্যবসায়ী আমাদের বাসায় ডিনারে এসেছিলেন। তাঁকে ভারি ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল। যখন আমরা খেতে বসলাম তখন তিনি ক্রমাগত বলতে থাকলেন তাঁর ব্যবসায় কত লাভ করছে, কী দারুণ চলছে সবকিছু। কিন্তু মা তাতে ভোলার পাত্রী ছিলেন না। তিনি সোজাসুজি বলেছিলেন, ‘আপনার ব্যবসা কত ভালো করছে তাতে কিছুই আসে-যায় না, যখন আপনি নিজেই ভালো নেই। আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আপনি নিজেই। আপনার স্বাস্থ্যের অ্যাকাউন্ট থেকে আপনি শুধু চেক তুলেই যাচ্ছেন। যদি শিগগিরই সেখানে কিছু জমা না করেন তবে দেউলিয়া হতে আর বেশি দিন বাকি নেই।’ কিছুদিন পরই সেই ব্যবসায়ীকে একটি বড় অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। 
সুস্থতার প্রতি মনোযোগ দিলে আরও একটি চমৎকার ব্যাপার ঘটবে। ভেবে দেখো তো সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিছুই করা হয়ে উঠছে না—এমন চিন্তা কখনো মাথায় আসে কি না? সব সময়ই আসে, তাই না? যখনই ঘড়ির দিকে তাকাও, দেখবে যা ভেবেছিলে তার চেয়ে বেশি বাজে। সমস্যা হচ্ছে, যতক্ষণ আমরা দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অর্থ আর ক্ষমতার পেছনে ছুটতে থাকব, জীবনের অন্য দিকগুলো দেখেও দেখা হবে না। আমরা কৌতূহলী হতে ভুলে যাব। আমার মাকে দেখেছি সারাক্ষণ কৌতূহলী চোখে জীবনকে উপভোগ করছেন, তিনি রান্নাঘরে বাসন ধোয়ার সময়ই হোক আর সাগরপারে শঙ্খচিলদের খাওয়ানোর সময়ই হোক। জীবনের ছোট ছোট জিনিস থেকে শুরু করে এই মহাবিশ্বের নানা রহস্য—সবকিছুই তাঁকে সমানভাবে মোহিত করে রাখত। আমি যখন কোনো ব্যাপার নিয়ে অভিযোগ করতাম বা মন খারাপ করে থাকতাম, মা বারবার আমাকে একটি উপদেশ দিতেন; বলতেন, ‘মামণি, চ্যানেলটা বদলে দাও। রিমোট তো তোমার নিজের হাতেই। ভয়ের ছবি আবার দেখার কী দরকার।’
পৃথিবীজুড়ে, রাজনীতি, ব্যবসা, মিডিয়া—সব ক্ষেত্রেই আমরা অনেক বুদ্ধিমান নেতৃত্বের দেখা পাই, যাঁরা কিছু জঘন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের আইকিউ বা বুদ্ধিমত্তার কোনো ঘাটতি নেই, বরং তাঁদের জ্ঞান ও বিবেকের অভাব রয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, আজকাল আমরা সবাই আমাদের অন্তর্নিহিত সত্তার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় হারাতে বসেছি। আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে অগুনতি যন্ত্র, চোখ আটকে আছে একাধিক স্ক্রিনে, সামাজিক জীবন বন্দী হয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়—এত কিছুর মায়া ছাড়িয়ে নিজেদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন আজ সত্যি কঠিন। 
আবার ফিরে আসি মায়ের গল্পে। মারা যাওয়ার আগে শেষবার মা আমার সঙ্গে রাগ করেছিলেন, যখন আমি একই সঙ্গে ই-মেইল পড়ছিলাম আর আমার সন্তানদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। মা রেগে বলেছিলেন, ‘আমি একসঙ্গে একের বেশি কাজ করা দুই চোখে দেখতে পারি না।’ সত্যিই তো, সারা পৃথিবীর সবকিছুর সঙ্গে ভাসা ভাসাভাবে যুক্ত থাকতে গিয়ে আমরা সবচেয়ে আপনজনদের কাছ থেকে হারিয়ে যাই, এমনকি নিজের কাছ থেকেও। আমি বলছি না প্রযুক্তি থেকে নিজেদের একদম বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। কিন্তু নিয়মিত, প্রয়োজন অনুসারে আমাদের যান্ত্রিকতাকে সরিয়ে রেখে নিজেদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। শুধু তার লাগিয়ে আমাদের যন্ত্রগুলোকে রিচার্জ করলে হবে না, তার খুলে রেখে আমাদের নিজেদেরও মানসিকভাবে রিচার্জ করে নিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, সব মানুষের ভেতরই জ্ঞান ও শক্তির একটি পুঞ্জীভূত সাম্যাবস্থা বিরাজ করে। পৃথিবীর সব ধর্মই বলে যে ঈশ্বরের অবস্থান মানুষের হূদয়ে—সে ইসলাম, খ্রিষ্ট, বৌদ্ধ বা অন্য যে আদর্শের অনুসারীই হোক না কেন। আমরা অন্তরের সেই অন্তস্তল থেকে প্রায়ই দূরে সরে যাই, জীবন এমনই। কিন্তু যখন আমরা সেই সংযোগ পুনঃস্থাপন করতে পারি, তা জীবনকে আগাগোড়া বদলে দেয়। বাধা-বিপত্তি-হতাশা যা-ই আসুক না কেন, আমাদের বিশ্বাস ফিরে আসে। জীবনের মানে তখনই বোঝা যায়, যখন আমরা পেছন ফিরে তাকাই। সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতিগুলোও তখন অর্থবহ হয়ে ওঠে। তাই এটা মনে করাই ভালো যে যা ঘটছে, আমাদের ভালোর জন্যই ঘটছে। 
আজ এই সুন্দর ক্যাম্পাস ছেড়ে যখন তোমরা নিজেদের স্বপ্ন সত্যি করার যাত্রা শুরু করছ, তখন তোমাদের কাছে আমার একটিই অনুরোধ, সমাজের চোখে যা সাফল্য, সেই মরীচিকার পেছনে ছুটো না। এই তথাকথিত সাফল্য লাভের ফর্মুলা কারও জন্যই কাজ করছে না। এমন সাফল্য নারীর জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়, পুরুষের জন্য নয়, এমনকি উত্তর মেরুর শ্বেতভালুকদের জন্যও এসব কোনো উপকারে আসবে না, এ আমি দিব্যি বলতে পারি! শুধু তাদেরই উপকারে আসবে, যারা ডায়াবেটিস, হূদরোগ, অনিদ্রা আর রক্তচাপের জন্য ওষুধ বানাচ্ছেন।
তাই অন্তঃসারশূন্য কোনো করপোরেট ব্যবস্থার বা রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েই আত্মতৃপ্তিতে ডুবে যেয়ো না। সমস্যার গভীরে প্রবেশ করো, সমাধানের পথ খুঁজে দেখো। জীবনের আসলে কিসের মূল্য আছে আর কী করলে সফল হওয়া যায়, সেই ধারণাগুলোকে বদলে দাও। মনে রেখো, কত টাকা উপার্জন করলে আর কত ওপরে উঠতে পারলে, এসব ব্যাপার তোমাকে অসংখ্যবার অসংখ্য মানুষ মনে করিয়ে দেবে, কিন্তু নিজের কাছে নিজে সৎ থাকলে কি না, নিজের যত্ন নিলে কি না, জীবনকে উপভোগ করতে পারলে কি না এসব কেউ তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে আসবে না। নিজের হূদয়ের সঙ্গে তোমার নিজের চেষ্টাতেই যুক্ত থাকতে হবে; যেখান থেকে সবকিছু সম্ভব হয়। আর সেখান থেকেই তুমি পারবে পৃথিবীকে বদলে দিতে, এমন পৃথিবী গড়তে, যেখানে নারী-পুরুষনির্বিশেষে আমরা সবাই ভালো থাকতে পারি, ভালোবাসতে পারি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার

No comments: