Thursday, November 12, 2015

জীবনে সফল হওয়ার ১০ টিপস

স্কুলে আপনার সঙ্গেই এক ক্লাসে পড়তো ছেলেটা। বরং পড়াশোনায়, রেজাল্টে আপনার থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়েই ছিল। অথচ আজ সে চড়ে ফেলেছে সাফল্যের সিঁড়ি। আর আপনি এখনও অভিযোগ, অসন্তোষে দিন কাটাচ্ছেন। কেন এমনটা হল বলুন তো? আপনার মতে ভাগ্যদেবী আপনার ওপর প্রসন্ন নন। সত্যিই কি তাই? নাকি আপনাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে নিজেরই কিছু অভ্যাস, দৃষ্টিভঙ্গি। সাকসেস ইজ নাথিং বাট অ্যান অ্যাটিটিউড। কথাটা শুনেছেন তো? জেনে নিন সফল মানুষদের কিছু অভ্যাস।
১। ঘুম থেকে ওঠা- এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠুন- আমরা দেরি করে উঠি। তারপর সময় না পাওয়ার বাহানা খুঁজি সারা দিন। এ দিকে যে কোনও সফল মানুষকে আপনি দেখবেন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে। আপনিও আদ থেকে এক ঘণ্টা এগিয়ে আনুন ঘুম থেকে ওঠার সময়। দেখবেন দিনটা অনেক বড় হয়ে যাবে। প্রথম দিকে একটু অসুবিধা হলেও ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।
২। ভিশুয়ালাইজ- নিজে জীবনে কী করতে চান সেই বিষয়ে যদি আপনার স্বচ্ছ ধারনা থাকে তবেই আপনি জীবনে সফল হতে পারবেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের পুরো দিনটা মনে মনে ছকে ফেলুন। সারা দিনে কী করতে চান, কোন কাজটা আপনাকে লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে তা মনে মনে ভেবে নিন। নিজেকে সফল ভাবতে শিখুন।
৩। ব্রেকফাস্ট- সারা দিন আপনার মুড ভাল রাখতে, আপনার এনার্জি বাড়াতে কিন্তু সকালে ঠিক করে খাওয়া প্রয়োজন। এ দিকে রোজ সকালে দেরিতে ওঠার জন্য আপনি ব্রেকফাস্টের সময়ই পান না। ব্যস্ততার দোহাই দেবেন না। সফল মানুষরা কিন্তু কখনই ব্রেকফাস্ট বাদ দেন না। তাই রোজ উপভোগ করে ব্রেকফাস্ট করুন।
৪। চেক লিস্টে- গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে রাখবেন না। আমরা কাজ ফেলে রাখি যত ক্ষণ না সেটা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। রোজ কী কী করবেন চেক-লিস্ট বানিয়ে ফেলুন। শুনতে জ্ঞানগর্ভ লাগলেও এটা অত্যন্ত ভাল অভ্যাস।
৫। নিজেক মোটিভেট করুন- আলস্য পেয়ে বসতে দেবেন না। সব সময় নিজের লক্ষ্য সামনে রাখুন। হাসির ছবি দেখুন, মন ভাল করে এমন কাজ করুন। রিল্যাক্স করুন। যাতে চাপ কমে এমন কাজ করুন। এই ভাবে নিজেকে মোটিভেট করুন। স্ট্রেস ধারে কাছে ঘেঁষতে দেবেন না।
৬। সক্রিয় থাকুন- ঘুম থেকে উঠেই কাজ শুরু করতে সমস্যা হয়। বাড়ি ফিরেও ক্লান্ত লাগে। হালকা শরীরচর্চা তাই আপনাকে সক্রিয় রাখতে জরুরি। রোজ ঘুম থেকে হালকা ব্যয়ামের রুটিন তৈরি করে ফেলুন। এতে পেশির শিথিলতা বাড়বে, রক্ত সঞ্চালন ভাল হয়ে আপনার কর্মক্ষমতা বাড়বে।
৭। বাড়ির খাবার খান- অফিসে খাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে লাঞ্চ, স্ন্যাকস নিয়ে যান। সফল হতে গেলে সুস্থ থাকতে হবে। তাই বাইরের খাবার না খেয়ে বাড়ির রান্না স্বাস্থকর খাবার খান। এতে সময়ও বাঁচবে। কাজের ফাঁকেই খেয়ে নিতে পারবেন ফলে খাওয়ার সময়ই ঠিকঠাক থাকবে।
৮। অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দিন- আপনার ঘর কি অগোছালো?  অফিসের ডেস্কে প্রচুর ফালতু কাগজ? অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে দিন। বাজে কাগজ বেশি থাকলে কাজের জিনিস খুঁজে পাবেন না। অন্য দিকে ঘর অগাছালো থাকলে আপনার কাজের এনার্জিও কমবে।
৯। রাত জাগবেন না- তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যান। সুস্থ, সবল থাকতে রাতের ঘুম প্রয়োজনীয়। অকারণে তাই রাত জাগবেন না। ল্যাপটপ বা মোবাইলে গল্প করে সময় নষ্ট করবেন না রাতে। প্ল্যান করে কাজ করলে রাত জেগে আপনাকে ফেলে রাখা কাজও করতে হবে না।
১০। কথা কম বলুন- কথা কম কাজ বেশি। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছেন এটা। আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। সফল মানুষরা কথা কম বলেন। চুপচাপ থাকলে মনসংযোগ বাড়ে, নিজের সঙ্গে কথা বলুন। আপনার কাজের মান বাড়বে।

॥॥আনন্দবাজার থেকে সংগ্রহিত

Saturday, November 7, 2015

একসঙ্গে একাধিক কাজ নয়: অ্যারিয়ানা হাফিংটন

গ্রিক-আমেরিকান লেখক ও কলামিস্ট অ্যারিয়ানা হাফিংটনের জন্ম ১৯৫০ সালের ১৫ জুলাই। অ্যারিয়ানা অনলাইন নিউজপোর্টাল হাফিংটন পোস্ট-এর সম্পাদক। তিনি ২০১৩ সালে স্মিথ কলেজের সমাবর্তনে এই বক্তব্য দেন।
অ্যারিয়ানা হাফিংটনঅভিনন্দন তোমাদের সবাইকে। সমাবর্তন বক্তাদের কাছ থেকে সবাই ‘সফল হওয়ার সহজ উপায়’-জাতীয় কিছু উপদেশ আশা করে। কিন্তু তার বদলে আমি চাইব সাফল্যের সম্পূর্ণ ধারণাটিকেই তোমরা ভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করো। আজকের পৃথিবীতে এটিই প্রয়োজন। শুধু শীর্ষ স্থান দখল করে বসে থাকলে হবে না, যেখানে আছো, সে স্থানটিকে বদলে দাও, পৃথিবীকে বদলে দাও। 
আমাদের সমাজে সাফল্য বলতে প্রধানত দুটো জিনিসকেই বোঝানো হয়: অর্থ ও ক্ষমতা। এমনকি সাফল্য, অর্থ ও ক্ষমতা—এই তিনটি শব্দ আজকাল প্রায় সমার্থক হয়ে পড়েছে। কিন্তু অর্থ ও ক্ষমতার বাইরেও আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। আমরা এমন সাফল্য চাইব, যার মধ্যে থাকবে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, জ্ঞান ও বিবেক, জীবনের প্রতি কৌতূহল ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা। শুধু অর্থ আর ক্ষমতা দুই পায়ের একটি টুলের মতো, এর ওপর ক্ষণিকের জন্য ভারসাম্য বজায় রাখা যায় কিন্তু একসময় তুমি ঠিকই উল্টে পড়বে। অসংখ্য সফল মানুষ এভাবেই উল্টে পড়েছেন, এখনো পড়ছেন। সাফল্যকে আমরা যেভাবে এত দিন ব্যাখ্যা করে এসেছি, তা আর গ্রহণযোগ্য নয়। সময় এসেছে জীবনকে নতুন চোখে দেখার। 
সফল হওয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের যতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তার পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলছে। নারীদের জন্য এই মূল্য আরও বেশি। যেসব নারী কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকেন, তাঁদের হূৎপিণ্ডের সমস্যায় ভোগার আশঙ্কা শতকরা ৪০ ভাগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এ শতাব্দীর কর্মজীবীরা, মানে তোমাদের মতো এত চাপ অতীতের কোনো প্রজন্মই মোকাবিলা করেনি। এই মুহূর্তে আমেরিকার অফিসগুলো কাজের চাপে বিধ্বস্ত, নির্ঘুম রাত কাটানো মানুষদের দিয়ে চলছে। ২০০৭ সালে আমার অবস্থাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। নিদ্রাহীন, পরিশ্রান্ত শরীরে আমি ডেস্কের ওপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার মাথায় আঘাত লেগেছিল, গালের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, ডান চোখের ওপর চারটা সেলাই দিতে হয়েছিল। নিদ্রাহীনতা যে শুধু শরীরের ক্ষতি করে তা নয়, এর ফলে তোমার সৃজনশীলতা, কর্মদক্ষতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা—সবকিছুতেই প্রভাব পড়ে। 
নিউইয়র্কে হাফিংটন পোস্ট-এর অফিসে দুটো রুম আছে শুধু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। প্রথম প্রথম আমাদের সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকৌশলীদের কেউই রুমগুলো ব্যবহার করতে চাইতেন না। তাঁরা ভাবতেন অন্যরা মনে করবেন কাজ ফাঁকি দিয়ে অফিসে এসে ঘুমানো হচ্ছে! অতঃপর আমরা অফিসের পরিবেশটা এমনভাবে বদলে ফেলেছি, যাতে বিশ্রাম নেওয়া নয়, বরং বিধ্বস্ত শরীরে হেঁটে বেড়ানোকেই বাঁকা চোখে দেখা হয়। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে এখন রুম দুটো খালি পাওয়াই মুশকিল! 
সাফল্যের সংজ্ঞায় সুস্থতাকে যোগ করার অর্থ হলো, জীবনে আর্থিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মানুষ হিসেবে আমাদের মানবিক চাহিদাগুলোর দিকেও নজর দেওয়া। আমার মা এই কাজটি খুব ভালো পারতেন। আমার বয়স যখন ১২, একদিন অত্যন্ত সফল এক ব্যবসায়ী আমাদের বাসায় ডিনারে এসেছিলেন। তাঁকে ভারি ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল। যখন আমরা খেতে বসলাম তখন তিনি ক্রমাগত বলতে থাকলেন তাঁর ব্যবসায় কত লাভ করছে, কী দারুণ চলছে সবকিছু। কিন্তু মা তাতে ভোলার পাত্রী ছিলেন না। তিনি সোজাসুজি বলেছিলেন, ‘আপনার ব্যবসা কত ভালো করছে তাতে কিছুই আসে-যায় না, যখন আপনি নিজেই ভালো নেই। আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আপনি নিজেই। আপনার স্বাস্থ্যের অ্যাকাউন্ট থেকে আপনি শুধু চেক তুলেই যাচ্ছেন। যদি শিগগিরই সেখানে কিছু জমা না করেন তবে দেউলিয়া হতে আর বেশি দিন বাকি নেই।’ কিছুদিন পরই সেই ব্যবসায়ীকে একটি বড় অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। 
সুস্থতার প্রতি মনোযোগ দিলে আরও একটি চমৎকার ব্যাপার ঘটবে। ভেবে দেখো তো সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিছুই করা হয়ে উঠছে না—এমন চিন্তা কখনো মাথায় আসে কি না? সব সময়ই আসে, তাই না? যখনই ঘড়ির দিকে তাকাও, দেখবে যা ভেবেছিলে তার চেয়ে বেশি বাজে। সমস্যা হচ্ছে, যতক্ষণ আমরা দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অর্থ আর ক্ষমতার পেছনে ছুটতে থাকব, জীবনের অন্য দিকগুলো দেখেও দেখা হবে না। আমরা কৌতূহলী হতে ভুলে যাব। আমার মাকে দেখেছি সারাক্ষণ কৌতূহলী চোখে জীবনকে উপভোগ করছেন, তিনি রান্নাঘরে বাসন ধোয়ার সময়ই হোক আর সাগরপারে শঙ্খচিলদের খাওয়ানোর সময়ই হোক। জীবনের ছোট ছোট জিনিস থেকে শুরু করে এই মহাবিশ্বের নানা রহস্য—সবকিছুই তাঁকে সমানভাবে মোহিত করে রাখত। আমি যখন কোনো ব্যাপার নিয়ে অভিযোগ করতাম বা মন খারাপ করে থাকতাম, মা বারবার আমাকে একটি উপদেশ দিতেন; বলতেন, ‘মামণি, চ্যানেলটা বদলে দাও। রিমোট তো তোমার নিজের হাতেই। ভয়ের ছবি আবার দেখার কী দরকার।’
পৃথিবীজুড়ে, রাজনীতি, ব্যবসা, মিডিয়া—সব ক্ষেত্রেই আমরা অনেক বুদ্ধিমান নেতৃত্বের দেখা পাই, যাঁরা কিছু জঘন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের আইকিউ বা বুদ্ধিমত্তার কোনো ঘাটতি নেই, বরং তাঁদের জ্ঞান ও বিবেকের অভাব রয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, আজকাল আমরা সবাই আমাদের অন্তর্নিহিত সত্তার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় হারাতে বসেছি। আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে অগুনতি যন্ত্র, চোখ আটকে আছে একাধিক স্ক্রিনে, সামাজিক জীবন বন্দী হয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়—এত কিছুর মায়া ছাড়িয়ে নিজেদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন আজ সত্যি কঠিন। 
আবার ফিরে আসি মায়ের গল্পে। মারা যাওয়ার আগে শেষবার মা আমার সঙ্গে রাগ করেছিলেন, যখন আমি একই সঙ্গে ই-মেইল পড়ছিলাম আর আমার সন্তানদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। মা রেগে বলেছিলেন, ‘আমি একসঙ্গে একের বেশি কাজ করা দুই চোখে দেখতে পারি না।’ সত্যিই তো, সারা পৃথিবীর সবকিছুর সঙ্গে ভাসা ভাসাভাবে যুক্ত থাকতে গিয়ে আমরা সবচেয়ে আপনজনদের কাছ থেকে হারিয়ে যাই, এমনকি নিজের কাছ থেকেও। আমি বলছি না প্রযুক্তি থেকে নিজেদের একদম বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। কিন্তু নিয়মিত, প্রয়োজন অনুসারে আমাদের যান্ত্রিকতাকে সরিয়ে রেখে নিজেদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। শুধু তার লাগিয়ে আমাদের যন্ত্রগুলোকে রিচার্জ করলে হবে না, তার খুলে রেখে আমাদের নিজেদেরও মানসিকভাবে রিচার্জ করে নিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, সব মানুষের ভেতরই জ্ঞান ও শক্তির একটি পুঞ্জীভূত সাম্যাবস্থা বিরাজ করে। পৃথিবীর সব ধর্মই বলে যে ঈশ্বরের অবস্থান মানুষের হূদয়ে—সে ইসলাম, খ্রিষ্ট, বৌদ্ধ বা অন্য যে আদর্শের অনুসারীই হোক না কেন। আমরা অন্তরের সেই অন্তস্তল থেকে প্রায়ই দূরে সরে যাই, জীবন এমনই। কিন্তু যখন আমরা সেই সংযোগ পুনঃস্থাপন করতে পারি, তা জীবনকে আগাগোড়া বদলে দেয়। বাধা-বিপত্তি-হতাশা যা-ই আসুক না কেন, আমাদের বিশ্বাস ফিরে আসে। জীবনের মানে তখনই বোঝা যায়, যখন আমরা পেছন ফিরে তাকাই। সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতিগুলোও তখন অর্থবহ হয়ে ওঠে। তাই এটা মনে করাই ভালো যে যা ঘটছে, আমাদের ভালোর জন্যই ঘটছে। 
আজ এই সুন্দর ক্যাম্পাস ছেড়ে যখন তোমরা নিজেদের স্বপ্ন সত্যি করার যাত্রা শুরু করছ, তখন তোমাদের কাছে আমার একটিই অনুরোধ, সমাজের চোখে যা সাফল্য, সেই মরীচিকার পেছনে ছুটো না। এই তথাকথিত সাফল্য লাভের ফর্মুলা কারও জন্যই কাজ করছে না। এমন সাফল্য নারীর জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়, পুরুষের জন্য নয়, এমনকি উত্তর মেরুর শ্বেতভালুকদের জন্যও এসব কোনো উপকারে আসবে না, এ আমি দিব্যি বলতে পারি! শুধু তাদেরই উপকারে আসবে, যারা ডায়াবেটিস, হূদরোগ, অনিদ্রা আর রক্তচাপের জন্য ওষুধ বানাচ্ছেন।
তাই অন্তঃসারশূন্য কোনো করপোরেট ব্যবস্থার বা রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েই আত্মতৃপ্তিতে ডুবে যেয়ো না। সমস্যার গভীরে প্রবেশ করো, সমাধানের পথ খুঁজে দেখো। জীবনের আসলে কিসের মূল্য আছে আর কী করলে সফল হওয়া যায়, সেই ধারণাগুলোকে বদলে দাও। মনে রেখো, কত টাকা উপার্জন করলে আর কত ওপরে উঠতে পারলে, এসব ব্যাপার তোমাকে অসংখ্যবার অসংখ্য মানুষ মনে করিয়ে দেবে, কিন্তু নিজের কাছে নিজে সৎ থাকলে কি না, নিজের যত্ন নিলে কি না, জীবনকে উপভোগ করতে পারলে কি না এসব কেউ তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে আসবে না। নিজের হূদয়ের সঙ্গে তোমার নিজের চেষ্টাতেই যুক্ত থাকতে হবে; যেখান থেকে সবকিছু সম্ভব হয়। আর সেখান থেকেই তুমি পারবে পৃথিবীকে বদলে দিতে, এমন পৃথিবী গড়তে, যেখানে নারী-পুরুষনির্বিশেষে আমরা সবাই ভালো থাকতে পারি, ভালোবাসতে পারি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার

কখনো একইভাবে দুবার হারবে না: চাক নরিস

চাক নরিস (জন্ম: মার্চ ১০, ১৯৪০) বিখ্যাত আমেরিকান মার্শাল আর্টিস্ট ও অভিনেতা। ২০০৮ সালে লিবার্টি ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে চাক নরিস যে বক্তৃতা দেন, এটি তার সংক্ষেপিত ভাষান্তর।
চাক নরিসতোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, আজকের সুন্দর সকালে আমাকে তোমাদের সামনে কিছু বলতে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। 
আমি স্বীকার করি, এই কাজটা আমি একদমই করতে পারি না। এটাই আমার প্রথম সমাবর্তন বক্তৃতা।
জীবনে সৃষ্টিকর্তা সব সময়ই আমাকে সাহায্য করে গেছেন, পথ দেখিয়েছেন। আমার জন্ম ওকলোহামাতে। বলতে বাধা নেই, আমার পরিবারে অনেক অভাব ছিল; কিন্তু আমার মা ছিলেন অসাধারণ একজন নারী। আর আমার বাবা ছিলেন একজন মদ্যপ, তিনি বলতে গেলে আমার জীবনে কোনো ভূমিকাই রাখেননি। 
ছোটবেলায় আমি অনেক লাজুক ও আত্মমুখী ছিলাম; খেলাধুলাও তেমন করতাম না। আমি কখনো স্কুলে আমার ক্লাসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে পারিনি। যখনই শিক্ষক আমাকে কিছু বলার জন্য ডাকতেন, আমি আমার নিজের সিটে বসে মাথা ঝাঁকাতাম। কারণ, আমি ভয় পেতাম, আমি কথা বললে সবাই হাসবে। যদিও আমার বসে থাকা দেখে অনেকে হাসত এবং এতে লজ্জায় আমার চেহারা লাল হয়ে যেত।
হাই স্কুল পাস করে আমি বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়ে কোরিয়া চলে গেলাম এবং সেখানেই মার্শাল আর্ট বিষয়টার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। ১৯৬১ সালে যখন আমি সেখান থেকে ফিরে আসি, আমার সঙ্গে ছিল তায়েকোয়ান্ডোর ব্ল্যাক বেল্ট ও জুডোর ব্রাউন বেল্ট। তখন আমেরিকার খুব বেশি লোক মার্শাল আর্ট সম্পর্কে জানত না। আমি একটি মার্শাল আর্ট ক্লাব খুললাম এবং সবাইকে আমন্ত্রণ জানালাম। আমি ভাবলাম, আমাকে নিশ্চয় আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সামনে কিছু বলতে হবে। আমি আধা পৃষ্ঠার একটি বক্তৃতা তৈরি করলাম এবং সাত দিন সেটা মুখস্থ করলাম। সেটা আমি এত ভালো মুখস্থ করেছিলাম যে উলটো দিক থেকেও তা বলতে পারতাম।
আমি ৫০০ জন আমন্ত্রিত অতিথির মাঝখানে হেঁটে গেলাম, আর বললাম, ‘শুভসন্ধ্যা। আমার নাম চাক নরিস এবং আমি আপনাদের এখানে অভিবাদন জানাচ্ছি’—এটাই ছিল শেষ বাক্য, যেটা আমার মনে আছে। এরপরের যে স্মৃতি আমার মনে আছে, সেটা হলো অতিথিদের মাঝখান থেকে চলে আসার এবং কিছু কায়দা দেখানোর স্মৃতি। আমি এখনো জানি না, সেদিন আমি অতিথিদের সামনে কী বলেছিলাম। আমি যে কাজটা করেছিলাম, সেটা ছিল ২১ বছর ধরে যে অবিশ্বাস নিজের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, সেটাকে ভেঙে ফেলা।
আমি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর লস অ্যাঞ্জেলসে প্রথম মার্শাল আর্ট স্কুল খুললাম। মার্শাল আর্টের মূল যে শিক্ষাটি আমি পেয়েছি সেটা হলো, একজন তখনই হারে, যখন সে পরাজয়ের অভিজ্ঞতাটি থেকে কোনো শিক্ষা পায় না। তাই আমি আমার ছাত্রদের শেখাই, তোমরা হারতে পারো, কিন্তু কখনো একইভাবে দুবার হারবে না।
আমার স্কুল ভালোই চলছিল, এ সময় একটি কোম্পানি এসে আমার স্কুলের স্বত্ব কিনে নিতে চাইল। তখন আমার তিনটি স্কুল ছিল। কোম্পানিটি আমাকে জানায়, তারা সারা দেশে ‘চাক নরিস মার্শাল আর্ট স্কুল’ খুলতে চায়। আমি ভাবলাম, ভালোই তো। আমি আমার স্কুলকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেব। এর দুই বছর পরে সেই কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে যায় এবং আমি আমার সব কটি স্কুল হারাই।
আমি কিন্তু থেমে যাইনি। নতুন করে কিকস্টার্ট নামে একটি ফাউন্ডেশন চালু করলাম। ১৫ বছর ধরে আমি হাজারো তরুণের মধ্যে মার্শাল আর্টের দর্শনকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছি। আমেরিকার লাখো মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের বাণিজ্যিক মার্শাল আর্ট স্কুলে পাঠাতে পারেন না। আমি ভেবেছি, কীভাবে তাঁদের সাহায্য করতে পারি। আমি ঠিক করলাম, প্রতি শহরের মিডল স্কুলগুলোতে বিনা মূল্যে আমি মার্শাল আর্ট শেখাব, যার ব্যয়ভার নেবে আমার ফাউন্ডেশন। 
এটা ছিল ১০ বছর আগের কথা। এর মধ্যে আমাদের স্কুল থেকে এক লাখ ৫০ হাজার তরুণ মার্শাল আর্ট শিক্ষা নিয়েছে। কিন্তু একজন ছেলের কথা আমি বিশেষ করে বলতে চাই, যে ছিল আমাদের জন্য সাফল্যের একটি বড় প্রেরণা। আমরা স্কুলে মূলত ষষ্ঠ,সপ্তম, অষ্টম মানের শিশুদের শিক্ষা দিই। কারণ, এ সময়েই শিশুরা সবচেয়ে দ্রুত শেখে। আমাদের লক্ষ্য থাকে, যাতে তারা এ সময়ে সঠিক পথ থেকে সরে না যায় এবং জীবনের লক্ষ্য ঠিক রাখে। কিন্তু আমাদের সেই ছেলেটি এই সময়ে একটি সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ছেলেটি ষষ্ঠ মানে পায় ‘ডি’ গ্রেড এবং তখন বাইরের দলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। কিন্তু মার্শাল আর্ট শুরু করার পরে তার চরিত্র পাল্টে যেতে থাকে এবং বাস্তবিকই সে ভালোর পথে আসে। সে তার অন্য দলের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে এবং তার পড়ালেখাতেও উন্নতি করতে থাকে। সপ্তম মানে তার গ্রেড আসে ‘সি’ এবং অষ্টম মানে এসে সে পায় ‘বি’ গ্রেড। মার্শাল আর্ট তার মনজগৎকে বদলে দেয় এবং ছেলেটি নবম থেকে ১২শ মান পর্যন্ত টানা ‘এ’ গ্রেড পেয়ে এমআইটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। 
মার্শাল আর্ট আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে। আমি মনে করি, এটা আরও অনেক তরুণের জীবন গড়ে দিতে সক্ষম। সৃষ্টিকর্তা আমাকে সব সময় সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তোমরা তাঁর ওপর বিশ্বাস আনো আর পরিশ্রম করে যাও, জীবনের সবকিছু ভালোভাবেই এগোবে। 
তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। 
সূত্র: ওয়েবসাইট, ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: মনীষ দাশ

রাজকুমার হিরানি : জীবনে থামতে জানতে হয়

পিকে (২০১৪) ও থ্রি ইডিয়টস (২০০৯) ছবির জন্য আলোচিত রাজকুমার হিরানি। হিরানি পরিচালিত অন্য দুটি চলচ্চিত্র মুন্নাভাই এমবিবিএস (২০০৩) ও লাগে রাহো মুন্না ভাই (২০০৬)। তাঁর জন্ম ১৯৬২ সালের ২০ নভেম্বর ভারতের নাগপুরে। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেও তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন চলচ্চিত্রকে।
আপনার জীবনাদর্শ কী? জীবনে বহুবার আমি এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। কখনোই প্রকৃত উত্তর খুঁজে পাইনি। আমরা আসলে কেউই জানি না আমরা কেন এই ধরাধামে এসেছি। মানুষ বাঁচে কত দিন? বড়জোর ষাট, সত্তর কিংবা আশি বছর? প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর আপনি যদি মনে করেন জীবনটা খুবই সংক্ষিপ্ত, তাহলে দেখবেন, জীবনটাকে আপনি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা প্রায় সবাই মনে করি, আমাদের হাতে প্রচুর সময় রয়েছে, জীবনের আয়ু সংক্ষিপ্ত নয়।
তাই আমি মনে করি, আমাদের প্রতি মুহূর্তে মনে করা উচিত, এ পৃথিবীতে আমাদের সময় খুব, খুব সামান্য। আজ থেকে ৫০ অথবা ৭৫ বছর পর কেউ হয়তো আমাকে আর চিনবে না। তো এসব চিন্তা করে ঘুম নষ্ট করার দরকার কী! এসব নিয়ে আমি মোটেও মাথা ঘামাই না। আমাদের প্রয়োজন টাকা, আমাদের প্রয়োজন সম্পদ, কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, এসব অর্জনেরও একটা সীমা আছে। আমি মনে করি, মানুষের জীবনে সত্যিকার অর্থে দুটি সমস্যা আছে—এক. স্বাস্থ্য ও দুই. দারিদ্র্য।
আপনি দেখবেন, যারা জ্যোতিষীর কাছে যায়, তারা জানতে চায় তাদের টাকাপয়সা কিংবা সম্পদ হবে কি না, তাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে কি না ইত্যাদি। কারণ জীবনের শেষ বেলায় এক সকালে উঠে আপনার মনে হবে, আপনার দেখভাল করার মতো কেউ আছে কি না। আর তখনই আপনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে।
আমি মনে করি, আমি সব সময় ও রকমটাই ভাবি। এটা কিছুটা বংশগত ব্যাপারও বটে। আমি সৌভাগ্যবশত এমন এক পরিবারে জন্মেছি যে পরিবারটা খুব একটা ধনী ছিল না। তবে বাবা চিন্তা-চেতনায় ছিলেন যথেষ্ট আধুনিক।
একবার আমাকে খুব ভয় দেখানো হলো। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে গিয়ে জানলাম, শরীরের কোনো একটা অংশ ঠিকঠাকমতো কাজ করছে না। চিকিৎসক বললেন, পরিবারের কাছে ফিরে যান, আপনি খুব শিগগিরই জটিল রোগে আক্রান্ত হবেন। চাপের মধ্যে ভালো কাজ করা মানে অনেকটা সংগ্রাম করার মতো। আমি সব সময় চেষ্টা করি এই ‘মানসিক চাপ’ বিষয়টাকে পাত্তা না দিতে।
বিলিয়ার্ড খেলোয়াড় গীত সিতাই একবার আমাকে বলেছিলেন, তিনি একবার থাইল্যান্ডে ফাইনাল খেলা খেলছিলেন। তাঁর প্রতিপক্ষের নাম ছিল সম্ভবত ওয়াত্তানা। এই খেলোয়াড় প্রচুর পয়েন্ট নিয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা খেলায় হেরে গেলেন এবং তারপর একের পর এক হারতে লাগলেন। স্বাভাবিকভাবেই গীত তখন খুব অবাক হয়েছিলেন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ব্যাপার কী? উত্তরে ওয়াত্তানা বলেছিলেন, আমি মনে করি, আমি সেই খেলায় অবশ্যই জিততাম। কিন্তু আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল পুরস্কারের টাকার দিকে। আমি ভাবছিলাম, পুরস্কারের টাকা পেলে আমার বাবার জন্য একটা বাড়ি কিনব। এই ভাবনা আমাকে কিছুটা বিভ্রান্ত করেছিল। আমি তখন কিছুটা নার্ভাস বোধ করছিলাম। কিছুতেই খেলায় মনঃসংযোগ করতে পারছিলাম না এবং যার ফলে আমার প্রতিপক্ষ খেলাটায় জিতেছিল।
গীতের এই গল্প থেকে আমি শিখেছিলাম, আপনি কী করছেন, তার লক্ষ্য ঠিক রাখা খুবই জরুরি।
আমি সম্প্রতি ক্রিস্টোফার নোলানের একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তিনি কোনো মুঠোফোন ব্যবহার করেন না। এমনকি তাঁর কোনো ই-মেইল আইডিও নেই। প্রতিদিন আপনি নাছোড় বান্দার মতো অন্তত ২০ হাজার মানুষের মনোযোগ চান। কিছু মানুষ এ বিষয়টিকে উপভোগ করতে পারে, তবে কিছু মানুষ মনে করে এটা এক ধরনের চিত্তবিনোদন। তো এ কথা বললাম এ জন্য যে আমাকে বিরক্ত করার কেউ নেই, না ফোন, না কোনো মানুষ। কিন্তু যখন আপনি একটু একটু করে পরিচিত হয়ে উঠবেন, তখন অনেক কিছুই আপনার পিছু লাগবে। জগতে চিত্তবিনোদনের অনেক উপাদান আছে। আপনাকে কর্মে সফল হতে হলে ওই সব থেকে অবশ্যই নিজেকে দূরে রাখতে হবে।
প্রত্যেকের বোঝা উচিত, ‘প্রয়োজন’ ও ‘লোভের’ মধ্যে পার্থক্য কী। আপনার জানা উচিত, ঠিক কোন জায়গাতে আপনাকে থামতে হবে এবং এটাও জানা উচিত, ‘আর নয়, বহুত হয়েছে’ কথাটা কখন বলতে হবে। অনিশ্চয়তা আপনাকে খতম করে দিচ্ছে? পৃথিবীর সবেচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তির দিকে তাকান, তিনিও বলবেন, ভয় লাগে, কখন সব শেষ হয়ে যায়! আপনি যদি এই অনিশ্চয়তার ভয় কাটাতে পারেন, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
অনেকেই আপনাকে খারাপ মানুষ মনে করতে পারে। কিন্তু আপনি নিজেকে কখনোই খারাপ মনে করেন না। এটা মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। এ বিষয়টি প্রথম মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল বোমান ইরানি, যখন আমরা একসঙ্গে মুন্না ভাই এমবিবিএস বানাচ্ছিলাম তখন। বিষয়টি নিয়ে বোমানের সঙ্গে অনেক বিতর্ক হয়েছে আমার। এরপর থেকে আমি যখন আমার ছবির কোনো চরিত্রের কথা ভাবি, তখন কখনোই সেই চরিত্রকে ‘ভিলেন’ হিসেবে ভাবি না। কারণ সে তাঁর জীবনে তো ‘হিরো’। নিজের জীবনে মানুষ কখনো নিজেকে ‘খলনায়ক’ হিসেবে দেখে না। সে কখনোই ভাবে না যে সে একজন খারাপ মানুষ।
সুতরাং এখন আপনি বুঝতেই পারছেন, আমরা আমাদের মাথার ভেতর আসলে গল্প তৈরি করি, ভিলেন বানাই।
কিছুদিন আগে মুম্বাই ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি বলেন, ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষার দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন আমাদের বাচ্চাদেরও হাতে পৌঁছে গেছে আইপ্যাড, আইফোন। এ যন্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে ভালো শিক্ষক।
থ্রি ইডিয়টস দেখার পর কত মানুষ আমার কাছে এসেছে, আমি তা বলে বোঝাতে পারব না। তারা বলেছে, তাদের মধ্যে কত গলদ আছে! আমি আপনাকে বলতে পারব না যে কত প্রকৌশলী আমার কাছে এসেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘আমরা ভুল পেশায় আছি। আমরা এখন কী করব? আমরা এ পেশা ছাড়তেও পারি না। ভয় লাগে, কারণ এটাই যে আমাদের উপার্জনের পথ। কেউ কেউ অবশ্য ছেড়েও দিচ্ছেন। কিছু চিকিৎসকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, তাঁরা তাঁদের পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।’
উপাচার্য মহাশয় সেদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ আছে। শিক্ষাব্যবস্থার বদল প্রয়োজন। কিন্তু এটা বদলাতে সবাই ভয় পায়। যেদিন আমরা এই ভয় থেকে মুক্ত হতে পারব, সেদিনই সত্যিকার পথ খুঁজে পাব।’
আমার মনে হয়, জীবনে সফল হওয়ার জন্য যেকোনো একটা বিষয় প্রয়োজন। কিন্তু মানব সম্প্রদায় হিসেবে আমরা বরাবরই আমাদের জীবন ও মনকে উদ্ভট পথে পরিচালিত করি। বেঁচে থাকার জন্য কিছু অর্থ উপার্জন করুন। দ্যাটস অ্যানাফ!
যাহোক, আমি শিক্ষা নিয়ে কথা বলছিলাম। বলছিলাম যে আমরা আসলে বাস করি কয়েক হাত ঘুরে আসা জ্ঞানের মধ্যে। বিষয়টি আর একটু পরিষ্কার করে বলা দরকার। যখন একটি পশু মারা যায়, সে আসলে মারাই যায়। পশুদের এমন কোনো প্রজন্ম নেই যারা তাদের জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সরবরাহ করতে পারে। কোনো পশুই বই লিখতে পারে না, যে বই বছরের পর বছর অন্য প্রাণীরা পড়তে পারে, কিন্তু মানুষ পারে। তাই মানুষের জ্ঞান আসলে ‘সেকেন্ডহ্যান্ড নলেজ!’
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে মারুফ ইসলাম

প্রতিভা দিয়েই সব হয় না : ম্যারি ব্যাররা

বিখ্যাত মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যারি ব্যাররা। ম্যারির জন্ম ১৯৬১ সালের ২৪ ডিসেম্বর। ২০১৪ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকাভুক্ত করে। ২০১৩ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ৩৫তম শক্তিশালী নারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ম্যারি ব্যাররা ২০১৪ সালের ৩ মে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই বক্তব্য দেন।
ম্যারি ব্যাররাউপস্থিত সব অভিভাবক, অতিথি আর সম্মানিত শিক্ষকদের ধন্যবাদ। আজকের অনুষ্ঠানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যারা, সেই ২০১৪ সালের স্নাতক শিক্ষার্থীদের আমার শুভেচ্ছা। এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমি থাকতে পেরে ভীষণ আনন্দিত।
আজ কেন জানি বারবার আমি আমার শিক্ষাজীবনে ফিরে যাচ্ছি। সমাবর্তনের সেই উত্তেজনা, আনন্দের কথা আমাকে এখন শিহরিত করছে। সেই দিন আমি যে প্রত্যয় আর স্বপ্ন দেখেছিলাম তা বারবার মনে পড়ছে। সেই সময়ের পৃথিবী এখন অনেক বদলে গেছে। এখন তো তোমরা একুশ শতকের স্নাতক। সমাজে তোমাদের বয়সের কিশোর আর তরুণদের সংখ্যাই বেশি। 
তোমাদের নিজেদের মধ্যে কিন্তু ভাবনার মিল কমই দেখা মেলে। যেমন ধরো, তোমাদের মধ্যে সবাই কিন্তু সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা মুঠোফোনের মধ্যে ডুবে থাকো না। নানা পরিসংখ্যান বলে, কিশোর আর তরুণদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের মাত্র একজন এই যন্ত্র-বন্ধুটিকে ছাড়া রাতে ঘুমোতে যাও। তোমরা সবাই ধনী নও, কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী প্রজন্মের সদস্য তোমরা। চিন্তা করে দেখো, আগের সময়ের পৃথিবীর মানুষের চেয়ে তোমরা কত বেশি সুযোগ-সুবিধা লাভ করো। তোমাদের ইন্টারনেট আছে, আছে আইফোন। 
তোমাদের আরেকটি কথা না বললেই নয়, তোমাদের এই প্রজন্মের বেশির ভাগ কিশোর আর তরুণই কিন্তু অমনোযোগী। হ্যাঁ, আমি তোমাদের অমনোযোগী বলছি। তোমরা কারও কথাই যেন শুনতে চাও না। আমি কিন্তু সবাইকে অমনোযোগী বলছি না, কেউ কেউ। এই যে শেষ তিন মিনিটে আমার কথা শুনতে শুনতে তোমাদের মধ্যে গুটি কয়েক নিজেকে খুদেবার্তা আর টুইট করা থেকে বিরত রাখতে পেরেছ। অন্যরা টুইট, স্ট্যাটাস আর টেক্সট নিয়ে ব্যস্ত।
আগের পৃথিবীর সবকিছু এখন বদলে গেলে, কিছু কিছু জিনিস কিন্তু এখনো আগের মতোই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তোমরা যে মানসিক দক্ষতা, গাণিতিক যুিক্ত, সমস্যা সমাধানের কৌশল, যোগাযোগ দক্ষতা, টিমওয়ার্ক নিয়ে জ্ঞান অর্জন করেছ তা কিন্তু অসাধারণ। ৩০ বছর আগে এগুলো ছিল সফলতার সূত্র। এখনো মানুষকে সফল হতে হলে এসব দক্ষতা প্রয়োজন। কিন্তু আমার চেয়েও এই সব তত্ত্বকথা তোমরা বেশি ভালো করে জানো, বোঝো। কারণ, আগে এসব গুণ সফলতার পথ নির্মাণ করত। আর এখন মানুষ এই সব দক্ষতা নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে।
ইন্টারনেটের কারণে তোমরা আগে থেকেই সব জানতে পারো। কিন্তু তার পরেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের দক্ষতা আর গুণ মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে। নিজেকে অন্যের চেয়ে দক্ষ করে তুলতে একাগ্রতার বিকল্প নেই। আমার সমাবর্তনের পর থেকে জীবনে অনেক কিছু শিখেছি। যা শিখেছি তার থেকে আধা ডজন নীতিকথা তোমাদের জানাতে চাই।
এক. যে কাজ একবার শুরু করেছ, তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হবে না। সফল হওয়ার ইচ্ছা আর পরিশ্রম দিয়ে সেই কাজ করে যাও। আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, স্কুল-কর্মস্থলে, পেশাজীবনে, খেলাধুলায় সব জায়গায় অনেক প্রতিভাবান লোকের দেখা মেলে। কিন্তু মনে রেখো, প্রতিভা দিয়েই সব হয় না। সফলতার জন্য তোমাদের প্রয়োজন প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম। সাফল্যের দরজায় জোরে ধাক্কা দাও। পরিশ্রম করো৷
যদি তুমি কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী হও, তাহলে তোমার একাগ্রতা আর পাগলামি তোমার দলের অন্যদের উৎসাহ জোগাবে। বড় কিছু অর্জনের জন্য যতটা সম্ভব পরিশ্রম করে যাও।
দুই. সব সময়ের জন্য সৎ থাকতে হবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে নিজেকে সৎভাবে প্রমাণিত করো৷ নিজের কাছে সততা সবচেয়ে বড় আত্মবিশ্বাস। কথা ভঙ্গ করবে না। তোমার গ্রাহকদের জন্য, পিতামাতার জন্য, কর্মীদের জন্য, পরিবারের জন্য, বন্ধুদের জন্য এবং নিজের জন্য, যেটা ঠিক সেটাই করবে সততার সঙ্গে।
তিন. বন্ধু তৈরি করো৷ মনে রেখো, সফলতা কখনো একা আসে না। একসময় তোমরা নিশ্চয়ই বড় বড় সাফল্য লাভ করবে। কিন্তু কখনোই একা একা তুমি কিছুই করতে পারবে না। বন্ধু তৈরি করো৷ সাফল্য সব সময় দলগত পরিশ্রমের সমষ্টিগত ফলাফল। তোমরা আগামীর দলনেতা। নেতৃত্বের জন্য তোমাদের অন্য মানুষের কাছ থেকে সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্য অর্জন করতে হবে। নিজের কথা বলার চেয়ে অন্যদের কথা শোনার অনন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে তোমার। সত্যি বলতে মানুষ তখনই তোমার প্রতি সহানুভূতি দেখাবে, যখন তুমি তাদের সহানুভূতি দেখাবে। জীবনের নানা প্রয়োজনীয় কাজের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে তোমাকে অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, বাড়াতে হবে বন্ধুর সংখ্যা।
চার. যেকোনো বাধা-বিঘ্নকে সামনে থেকে মোকাবিলা করতে হবে। বাড়ি কিংবা অফিসে যেখানেই তুমি কোনো সমস্যা দেখবে, তার সম্মুখীন হও। তোমার যা কিছু আছে তা নিয়েই সমস্যার সমাধান করো৷ আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, যেকোনো সমস্যা সমাধানে পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাও। মনে রেখো, সমস্যার সমাধান সামনে থেকেই করতে হয়। সমস্যাকে যতই অবজ্ঞা করবে, ততই তা বড় হয়ে উঠবে।
পাঁচ. অন্যের জন্য কিছু করো৷ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আর উদ্ভাবনী প্রযুক্তির এই সময়ে তোমাদের সামনে আছে অনেক সুযোগ। অনেক কিছু করে ফেলতে পারবে তোমরা। কিন্তু সবকিছুর আগে একটা কাজ করতে কখনোই ভুলবে না। নিজের মেধা দিয়ে অন্যের জন্য ভালো কিছু করবে সব সময়। আমি জানি, আজকের এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বেশ কজন স্পাইডারম্যান-ভক্ত আছে। স্পাইডারম্যান সিনেমার সেই উক্তি নিশ্চয়ই তোমাদের মনে আছে? ‘অধিক ক্ষমতা অন্যের প্রতি তোমার বড় দায়িত্ব তৈরি করে।’ 
সর্বশেষ, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো৷ আমি এই বিশেষ দিনে তোমার বন্ধু, পরিবার এবং নিজের ওপর বিশ্বাস রাখার কথা বলছি। নিজের বন্ধু আর পরিবারকে সব সময় কাছে রাখবে। আমি তোমাদের পরিবার আর বন্ধু কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলে বোঝাতে পারব না। তারাই তোমার পথ চলাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারে। ভালো সময়গুলো তাদের সঙ্গে উদ্যাপন করো৷ আর কঠিন সময়গুলোতে পরিবার আর বন্ধুদের পরামর্শ নাও। নিজের বিশ্বাসের ওপর আস্থা রাখো।
আমি আজকের বক্তৃতার প্রথম দিকে তোমাদের ধনী, সৌভাগ্যবান প্রজন্ম বলে হালকা হেয় করলেও একটা কথা কিন্তু এখনো বলিনি। তোমরা পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উদ্ভাবনী এবং প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ একটি প্রজন্ম। তোমাদের হাতের মুঠোয় এখন সমাজ বদলের নানা অনুষঙ্গ। তোমাদের সামান্য চিন্তায় এখন বদলে যায় সমাজ। সামনে যে সুযোগ আসবে, সেটাই খপ করে ধরে ফেলবে। ক্যারিয়ারের শুরুতে যা করার সুযোগ পাবে তা-ই করবে। সব নতুন অভিজ্ঞতা তোমার দক্ষতাকে বিকশিত করবে, দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দেবে। যেকোনো কাজকে ভালোবাসো। কাজ উপভোগ করো। অভিজ্ঞতাই তোমার সাফল্যের গতি নির্ধারণ করে দেবে। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে মনোযোগী হও। তোমাদের সবাইকে আমার অভিনন্দন। আমি তোমাদের প্রত্যেককে নিয়ে আজ আনন্দিত ও গর্বিত। সবাইকে ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্র: ওয়েবসাইট, ভাষান্তরে জাহিদ হোসাইন খান

আজ যা কল্পনা তা আগামীর বাস্তবতা : সুন্দর পিচাই

সুন্দর পিচাইসুন্দর পিচাই গুগল–এর নতুন সিইও। জন্ম ১৯৭২ সালের ১২ জুলাই ভারতের চেন্নাইতে। আইআইটি থেকে পড়াশোনা শেষে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। তিনি অ্যানড্রয়েড মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম, ক্রোম ব্রাউজারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমি সব সময় উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ভক্ত। সাধারণ মানুষের জন্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ করার আনন্দ অন্য রকম হয়। গুগল ইনকরপোরেটেডের মাধ্যমে আমরা এ কাজটি সারা বিশ্বে করে যাচ্ছি। গুগলের মূল আদর্শই হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছানো।
আমার জন্ম চেন্নাইতে। আমি আইআইটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে আসি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার অন্যতম আগ্রহ ছিল কম্পিউটার। গুগলে কাজের সুযোগ পেয়ে আমি সেই আগ্রহের জায়গায় কাজ করার অনেক সুযোগ পেয়েছি। আমি ছোটবেলায় সংখ্যা মনে রাখতে পারতাম অনেক। অনেক ফোন নম্বর মুখস্থ করতে পারতাম। আমার চাচা মাঝেমধ্যেই আমাকে ফোন দিয়ে হারানো অনেক নম্বর জিজ্ঞেস করতেন। ২০০৪ সালে আমি গুগল অফিস গুগলপ্লেক্সে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে যাই। সেদিন গুগল জিমেইল চালু করে। এপ্রিলের প্রথম দিন দেখে আমি ভেবেছিল জিমেইল আসলে গুগলের কোনো রসিকতা হবে।
তরুণদের ওপর আমার ভরসা অনেক বেশি। আমি নিজেও তরুণ বয়সে অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম। এখনকার তরুণদের সাহস দেখে আমি শক্তি পাই। আমার মনে হয় আগামীর ই-কমার্স দুনিয়ার পুরোটার নেতৃত্ব দেবে তরুণেরা।
প্রযুক্তির ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। টেলিভিশন থেকে শুরু করে মুঠোফোন—সবারই মন্দ দিক আছে। মন্দ দিক এড়িয়ে প্রযুক্তিকে উন্নয়নের জন্য কাজে লাগানোই হবে কাজের কাজ। এখন আমাদের হাতের মুঠোয় দুনিয়া চলে আসছে। স্মার্টফোন আসলে একেকটি কম্পিউটারের কাজ করে, যা আমাদের পকেটে ঘুরছে সব সময়। প্রযুক্তি দিয়ে দুনিয়া বদলে দেওয়া সম্ভব এখন। মুঠোফোন আসার আগে আমি একসঙ্গে অনেক কাজ করতে পারতাম না। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন মিটিং আর ই-মেইল একসঙ্গে করতে পারছি আমরা। দুনিয়া সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়ছে। সেই হিসেবে প্রযুক্তির দক্ষতা আর সক্ষমতাও এগিয়ে চলছে। মানুষের বুদ্ধি আর প্রযুক্তির দক্ষতা যেন এখন একটা বড় আনন্দময় ভ্রমণ। আগামীকাল কী প্রযুক্তি আসবে, তা মানুষ বুদ্ধি দিয়ে আগেই জেনে নিচ্ছে। আজ যা কল্পনা তা আগামীর বাস্তবতা।
গুগলে আমি একটাই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। মানুষকে আরও বেশি প্রযুক্তি সংযোগ আর কানেক্টিভিটিতে আনা যায় তা নিয়ে ভাবি আমি। মুঠোফোন দিয়ে মানুষকে ইন্টারনেটে বেশি মাত্রায় সংযোগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির মাধ্যমে বদল আনতে সব সময় আমরা ভাবি। চালকবিহীন গাড়ি থেকে শুরু করে গুগল গ্লাস, এ সবের মাধ্যমে প্রতিদিনকার জীবনে প্রযুক্তির ছোঁয়া দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা।
আমাদের সামনে সমস্যা কী আমরা জানি, সমস্যা কীভাবে সমাধান করতে হয় সেটাও আমরা বুঝি। সাধারণ মানুষের নানা সমস্যার সমাধান করা বেশ কষ্টকর হলেও প্রযুক্তিবিদেরা সমস্যার সমাধান নিয়েই সময় কাটান। ভারতসহ পৃথিবীর অনেক জায়গায় এখনো ইন্টারনেট সবার জন্য সহজলভ্য হয়নি। এই বিশাল সংখ্যার মানুষকে কানেক্টিভিটির আওতায় আনলে সারা পৃথিবীরই সার্বিক উন্নয়ন হবে।
এই পৃথিবীতে চার শ কোটির বেশি মানুষ এখনো ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে আছে। আমরা এ অবস্থা বদলাতে চাই। আমরা সবাইকে ইন্টারনেটের ছাতার নিচে আনার জন্য ‘লুন’ নামের বিশাল একটি কর্মসূচি নিয়েছি। প্রায় দুই বছর আগে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছি। তখন এই বেলুন তিন দিনের জন্য আকাশে উড়তে পারত, প্রযুক্তির দারুণ কৌশলে এই বেলুন এখন টানা ছয় মাস আকাশে ভেসে থ্রিজি সেবা দিতে পারছে।
তরুণ প্রকৌশলীদের জন্য আমার পরামর্শ থাকবে সব সময় বেশি চিন্তা না করা। আমি নিজে প্রকৌশলী হিসেবে সবাইকে যার যা করতে ভালো লাগে, তাই করার উৎসাহ দিই। আগ্রহের জায়গায় কাজ করলে অনেক আনন্দ পাওয়া যায়। বড় মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে তা কাজে লাগানো উচিত। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। তোমার যদি কোনো কিছুর মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়, তা নিয়েই কাজ করা উচিত। আমি সারা জীবনই এই আদর্শে কাজ করে যাচ্ছি।

সূত্র: ইন্টারনেট। দ্য ভার্জ, এনডিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে ভাষান্তর করেছেন জাহিদ হোসাইন খান

ক্রিকেটই আমার জীবন : শচীন টেন্ডুলকার

সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার। ২০১১ সালের বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলের সদস্য। ১৯৮৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। জন্ম ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করেছেন ১০০টি সেঞ্চুরি। খেলেছেন ২০০টি টেস্ট। টেস্টে ৫১টি সেঞ্চুরিসহ ১৫ হাজার ৯২১ রান এবং ৪৬৩টি ওয়ানডে ক্রিকেটে ৪৯টি সেঞ্চুরিসহ ১৮ হাজার ৪২৬ রানের মালিক তিনি।
শচীন টেন্ডুলকারশুধু ভারতের হয়ে খেলা গত ২২ বছর ধরে নয়, তারও অনেক আগে থেকেই ক্রিকেট আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ১১ বছর বয়সে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে ক্রিকেট আমি সিরিয়াসলি খেলব, তখন থেকে ক্রিকেটই আমার জগৎ। এর আগেও আমি ক্রিকেট খেলতাম, কিন্তু সেটা ছিল আমার পড়শি বন্ধুদের সঙ্গে মজা করে টেনিস বল দিয়ে খেলা—এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু যে মুহূর্ত থেকে আমি ঠিক করলাম, আমি ক্রিকেট খেলব এবং আমার লক্ষ্য হবে ভারতের হয়ে খেলা; সে মুহূর্ত থেকে আমার জীবনে যা ঘটেছে, তা ক্রিকেটকে ক্রিকেটকে কেন্দ্র করেই ঘটেছে। আমার জীবনের সব দায়িত্ব, সব চাপ সামাল দিয়েছে আমার বড় ভাই অজিত এবং বিয়ের পরে আমার স্ত্রী অঞ্জলি। এ কথা বললে ভুল হবে না, আমার জীবনের মঞ্চে সামনে ছিল শুধুই ক্রিকেট, বাকি সবই পেছনে। 
আমি যখন স্কুলে পড়তাম, অনেকবারই আমার ইচ্ছা হয়েছে প্র্যাকটিসে না গিয়ে আমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলি। তাদের সঙ্গে ভেলপুরি, পানিপুরি খেয়ে সময় কাটাই; সিনেমা দেখি, টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলি কিংবা বাসার সামনে ছোটাছুটি করি—১২ বছর বয়সী একটি ছেলের এসবই তো করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমার কোচ রমাকান্ত আচরেকার তাঁর স্কুটার নিয়ে শিবাজি পার্ক থেকে চলে আসতেন এবং আমাকে নিয়ে যেতেন। তিনি আমাকে ক্রিকেট খেলিয়েই ছাড়তেন। আমি অনেকবার লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু প্রতিবারই তিনি আমাকে খুঁজে বের করতেন। এখন যখন আমি পেছনে ফিরে তাকাই এবং সেসব দিনের কথা ভাবি, যখন আমি ক্রিকেট খেলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াতাম, আমি খুবই আনন্দ পাই এই ভেবে যে এসব আমার জীবনে হয়েছে। এ ঘটনাগুলো না ঘটলে জীবনে আমি অনেক কিছুই পেতাম না। ক্রিকেটে আমার সাফল্যের পেছনে আমার বড় ভাই অজিত এবং কোচ রমাকান্ত আচরেকারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
আমি ভারতের ক্রিকেট ক্যাপ প্রথম মাথায় দিই ১৯৮৯ সালে, পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের আগের প্রস্তুতি ম্যাচে। সেটা ছিল আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর অন্যতম। ভারতীয় দলের টুপি, সোয়েটার, জার্সি—সবকিছুই আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি সব সময় মাঠে নেমেছি বড় রান করার জন্য। আমার সব ব্যক্তিগত রেকর্ড, মানুষ আমার যেসব বড় রানের কথা স্মরণ করে—সবকিছুই এসেছে ভারতের হয়ে খেলতে গিয়ে। আমি ভালো বা খারাপ, যা-ই খেলি না কেন, ভারতের হয়ে খেলতে গিয়েই এসব এসেছে এবং সব সময়ই আমার লক্ষ্য ছিল একটাই—মাঠে নেমে ম্যাচ জিতে আসা। এটা করতে গিয়ে আমি যা অর্জন করেছি কিংবা যা অর্জন করতে পারিনি, এসব ছিল আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমি আমার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি সব সময়। আমি বিশ্বাস করি, একজন খেলোয়াড়ের জন্য ম্যাচের আগের প্রস্তুতি সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করে, এটা নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগায় যে আমি আমার সেরাটা দিতে পারব। কিন্তু ম্যাচে কী হবে, সেটা একমাত্র সর্বশক্তিমানই জানেন, আমরা সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। কখনো ম্যাচের ফল আমাদের পক্ষে যায়, কখনো বিপক্ষে—আমরা সব সময় মাঠে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করি।
স্বপ্ন দেখা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্নের পেছনে শ্রম দেওয়া। আমরা স্বপ্ন দেখি নিদ্রায়, কিন্তু কাজ করি জেগে থেকে; জেগে থাকাটাও আমাদের জীবনে সমান গুরুত্ববহ। আমি যেভাবে নিজেকে ম্যাচের জন্য প্রস্তুত করি, তাতে প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমার হাতে থাকে। নিজের প্রস্তুতির কাজটা আমি নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। মাঠে খেলতে নেমে কোনো খেলোয়াড়ই এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে না যে আমি আজকে সেঞ্চুরি করব বা পাঁচ উইকেট তুলে নেব। কিন্তু সম্পূর্ণ প্রস্তুতির গ্যারান্টি একজন খেলোয়াড় দিতে পারে, কারণ এটা তার নিয়ন্ত্রণের আওতায়। একজন খেলোয়াড়ের উচিত নিজের নিয়ন্ত্রণের আওতায় যে জিনিসগুলো আছে, সে ব্যাপারগুলোতে সময় দেওয়া। আর যে ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেগুলোকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া। আমি যখন জানি যে আমি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি এবং এর চেয়ে আর ভালো কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তখন আমি নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাই। খেলায় আমি চেষ্টা করি নিজের চিন্তাকে যতটা সম্ভব শূন্য রাখতে, এতে করে আমি যেকোনো বলকে তার মতো করেই খেলতে পারি। এটা আমার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আসে।
এটা ভাবতে আমার খুবই ভালো লাগে যে মানুষ আমার খেলাকে ভালোবেসেছে, আমাকে সমর্থন দিয়েছে, আমার জন্য প্রার্থনা করেছে। এমন অনেক মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, যারা আমার মঙ্গল কামনায় কয়েক সপ্তাহ ধরে উপবাস পালন করেছে। আমি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই এ সবকিছুর জন্য এবং প্রার্থনা করি, সবকিছু যেন এভাবেই চলতে থাকে। যখন কেউ কোনো কাজে নিজের মনপ্রাণ ঢেলে দেয় এবং লাখ লাখ মানুষ তার সেই কাজের প্রশংসা করে—এটা সেই মানুষকে অসীম আনন্দ এনে দেয়, তার প্রতি মুহূর্তের শ্রমকে সার্থক করে তোলে। আমি সেই মানুষ হতে পেরেছি, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

সূত্র: ডেইলি মোশন ডট কম। অর্ণব গোস্বামীকে দেওয়া শচীন টেন্ডুলকারের সাক্ষাৎকার অবলম্বনে লিখেছেন মনীষ দাশ

আমি কখনো হাল ছাড়ি না: মারিয়া শারাপোভা

মারিয়া শারাপোভা বিশ্বের অন্যতম আলোচিত টেনিস খেলোয়াড়। শারাপোভার জন্ম রাশিয়ায়, ১৯৮৭ সালের ১৯ এপ্রিল। এ যাবৎ তিনি টেনিসের পাঁচটি গ্র্যান্ড স্লাম জয় করেছেন। ২০০৭ সাল থেকে মারিয়া জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করছেন।
মারিয়া শারাপোভা১৭ বছর বয়সে আমি উইম্বলডন জয় করি। এর কয়েক বছরের মধ্যেই মারাত্মকভাবে কাঁধের ইনজুরিতে পড়ে আমার খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আমার সামনে অনেক কারণ ছিল, যার জন্য টেনিস খেলাই ছেড়ে দেওয়ার কথা তুলেছিল অনেকে। ইচ্ছা করলেই তখন খেলা ছেড়ে দিতে পারতাম, কিন্তু হাল না ছেড়ে আবার কোর্টে নামার সাহস করি।
সত্যিকার অর্থে, আমার বেড়ে ওঠা ছিল ছাই থেকে। আবর্জনা থেকে আমার পরিবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। আমার শিকড় কোথায়, সেটা আমি জানি। আমার শুরুর সেই কষ্টের দিনগুলো আমি কখনোই ভুলতে পারব না। আমার বাবা-মা দুজনেই বেলারুশ থেকে আসেন। আমি যখন মায়ের পেটে, তখন চেরনোবিল দুর্যোগ ঘটে। বাবা আর মায়ের কাজ চলে যায়। তাঁদের বাকি জীবনটা অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গেছে। আমি তাঁদের মেয়ে। বাবা চার বছর বয়সে আমার হাতে টেনিস র্যাকেট তুলে দেন। বাবাই ছিলেন আমার প্রথম কোচ। স্কুলে পড়াশোনা আর বাড়ির কাজ শেষ করে প্রতিদিন টেনিস অনুশীলনে নামতাম।
আমি কোনো কিছু ধরলে তা ছাড়ি না। আমার বিখ্যাত কোনো বন্ধু ছিল না, যার মাধ্যমে আমি খ্যাতি অর্জন করতে পারি। কিংবা আমি ফ্যাশন মডেল নই, যাকে কোনো লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন বিখ্যাত করেছে। মূল কথা হচ্ছে, টেনিসই আমাকে সব দিয়েছে। ইনজুরিতে থাকার সময় যখন ম্যাগাজিন আর পত্রিকায় আমার ছবি দেখতাম, তখন ঠিক থাকতে পারতাম না। হাসপাতালে বসে কোর্টে দৌড়ানোর শব্দ পেতাম। আর দৌড়াব বলেই টেনিস কোর্টে ফিরে আসি।
আমি সব সময় মাঠে থাকতে চাই। প্রতিদিন। জয়-পরাজয় নিয়ে ভাবি না। মাঠে থাকাই সব। খেলা শেষে ঘেমে একাকার হয়ে বাড়ি ফিরতে চাই।
আমার বেড়ে ওঠা ছিল রাশিয়ার সোচি শহরে। যুক্তরাষ্ট্রে সবাইকে সোচি নামের বানান করে বলতে হতো। কেউ জানত না সোচি মানচিত্রের কোথায়। এখন আমার জন্য অনেকেই মানচিত্রে সোচি শহরকে চেনে। এটা অনেক আনন্দের। আমি যখন রাশিয়ার পতাকা নিয়ে কোথাও দাঁড়াই, তখন আমার চেয়ে গর্বিত আর কে হয় বলুন?
খেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এক টেনিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিলাম। যার জন্য মায়ের সঙ্গে প্রায় দুই বছর দেখা হয়নি। তখন আমাদের মুঠোফোন ছিল না, কোনো ই-মেইলও ছিল না। একটা কলম আর এক টুকরা কাগজই ছিল আমার সব। মাকে চিঠি লিখতাম। চিঠি যখন মায়ের কাছে যেত, তখন আমার যে অনুভূতি হতো, তা এখনো শিহরিত করে।
টেনিস খেলার একাডেমিতে অন্য মেয়েরা আমাকে নিয়ে হাসত। বেশি ছোট ছিলাম বলে র্যাগিংয়ের শিকার হতাম। আমাকে টিজ করা হতো। তখন আমি হতাশ হয়ে একা একা কাঁদতাম, কিন্তু আমার লক্ষ্য আমি জানতাম। রেগে দেশে ফিরে গেলে আমি হয়তো আজকের আমি হতাম না। সব সময় আশাবাদী হয়ে থাকলে বিপদে পড়লেও নিজেকে নিজে উদ্ধার করা যায়। কষ্ট করে লেগে থাকতে হয় স্বপ্নের পেছনে।
২০০৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে উইম্বলডন জেতা ছিল আমার জন্য বিস্ময়। এটা স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। কখনোই চিন্তা করিনি মাত্র দুই সপ্তাহে পৃথিবীর সেরা সব টেনিস খেলোয়াড়কে হারিয়ে দেব! ফাইনালে আমি সেরেনা উইলিয়ামসকে হারিয়ে দিই। আমি কতটা দুর্ধর্ষ টেনিস খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিলাম, তা ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। কোনো দিকে মন না দিয়ে টেনিস বলেই আঘাতের পর আঘাত করে গিয়েছি। ফলে ফাইনালে আমার হাতেই ছিল সেরার পদকটি।
বেঁচে থাকার জন্য আমি টেনিস বলকে আঘাত করি, পরিশ্রম করি। আমি সব সময় সবার কাছ থেকে শেখার আগ্রহ নিয়ে বসে থাকি। বাবা আর মায়ের কাছ থেকেই আমি কৌতূহলী হয়ে ওঠার নেশাটি পেয়েছি। আমার কাছে সবচেয়ে বড় আর গুরুত্বের বিষয় হলো, প্রথমে ভালো মানুষ হওয়া, তারপর পেশাদার ক্রীড়াবিদ হতে হবে। এটা সত্যি অনন্য এক চ্যালেঞ্জ।
বেঁচে থাকার জন্য বন্ধুর বিকল্প নেই। আমি সুযোগ পেলেই বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যাই, গান গাই। টেনিস নিয়ে পড়ে থাকলেও পরিবারকে সময় দিই। যখন খুব হতাশায় ভুগি, তখন নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিই। নেইলপলিশ হাতে গ্র্যান্ড স্লামের ট্রফিগুলো তোলার স্মৃতি বারবার মনে করে নিজেকে সাহস দিই। আর হতাশার মাত্রা চরমে উঠলে গলা ছেড়ে গান গাই। প্রতিদিন সকালে আমি গান শুনে বাড়ি থেকে বের হই। আমার দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো মায়ের হাতের রান্না। মায়ের হাতের বৈচিত্র্যময় রান্নার জন্য বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে আমার। আমি সময় পেলেই বইয়ের পাতায় হারিয়ে যাই। একই বই কয়েকবার পড়ার বাতিক আছে আমার।
আমাকে কেউ কেউ ‘সুগারপোভা’ নামে ডাকে। অনেক ছোটবেলা থেকে আমি চকলেটের ভক্ত। আমার দাঁতে সব সময় চিনি লেগে থাকত। আমি চাইতাম বড় হয়ে আমি চকলেটের দোকান দেব। বড় হয়ে ব্যবসায়ী হব। সত্যি সত্যি টেনিস খেলার ক্যারিয়ার শেষ করে ব্যবসা করতে নামব।
মানুষের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা সে নিজেই। নিজেকে সাফল্যের চূড়ায় দেখতে চাইলে মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। যখন যা করো, তা-ই উপভোগ করো। বাড়িতে থাকলে টিভি দেখো, সিনেমা উপভোগ করো। হাসো। কিন্তু যখন কাজ করবে, তখন তাকে উপভোগ করো। নিজের প্রতিভা আর বুদ্ধি দিয়ে কঠিন সব কাজকে আয়ত্তে আনাই সফল ব্যক্তিদের কাজ। নিজের জীবনকে নিজেকেই আকর্ষণীয় করে তুলতে হয়। গণ্ডির মধ্যে না থেকে মাঝেমধ্যে পাগলামি করো। পাগলামি করা শেখো। সামান্য কিছুতেই হাসতে শেখো। হাসিই সবচেয়ে বড় ওষুধ। ঝুঁকি নিতে শেখো। দাঁতে পোকা ধরার ঝুঁকি থাকলেও মাঝেমধ্যে চকলেট খাও। নিজেকে নিয়ে খুশি থাকো!
কিশোর বয়সে যারা টেনিস খেলতে চায়, তাদের জন্য আমার পরামর্শ, লেগে থাকতে হবে। পড়তে হবে, জানতে হবে, খেলতে হবে। সবকিছুর জন্য চাই কঠিন অনুশীলন। ব্যর্থ হলেও লেগে থাকতেই হবে। সফল হলেও লেগে থাকতে হবে।
তথ্যসূত্র: টেলিগ্রাফকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে লিখেছেন
জাহিদ হোসাইন খান

নিজের মতো হও : অপরাহ উইনফ্রে

Untitled-5অপরাহ উইনফ্রে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও ধনী উপস্থাপক। তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি স্বপরিচালিত ‘দি অপরাহ উইনফ্রে শো’র জন্য। ১৯৮৬ সালে শুরু হওয়া এই শো শেষ হয় ২০১১-তে। যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপিতে ১৯৫৪ সালের ২৯ জানুয়ারি তাঁর জন্ম। ২০১৩ সালের ৩০ মে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি এই বক্তব্য দেন।ভাবতেই দারুণ লাগছে যে আমি এখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তোমাদের জীবনে আজকের এই দিনটা একটা বিশেষ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি আর নতুন অধ্যায় শুরুর সময়। আমি খুবই কৃতজ্ঞ হার্ভার্ড থেকে সম্মানজনক ডক্টরেট অর্জন করতে পেরে।আমার টেলিভিশনের ক্যারিয়ার বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই শুরু হয়েছিল। আমি মিস ফায়ার প্রিভেনশন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। সেখানে প্রশ্ন-উত্তরের একটা পর্ব ছিল। আমাকে প্রশ্ন করা হলো যে আমি বড় হয়ে কী হতে চাই? ঝটপট উত্তর দিয়ে দিলাম, আমি একজন সাংবাদিক হতে চাই। আমি এমনভাবে মানুষের গল্পগুলোকে অন্যদের কাছে তুলে ধরতে চাই, যাতে তাদের জীবনে তা কিছুটা হলেও ভিন্নতা নিয়ে আসে। উত্তরটা দিয়ে আমি নিজেই বেশ অবাক হলাম। বাহ্! দারুণ তো! আমি সাংবাদিক হতে চাই, আমি পরিবর্তন চাই।আমি যখন টেলিভিশনে কাজ করা শুরু করি, তখন আমার বয়স ১৯ বছর। ১৯৮৬ সালে আমি আমার নিজের টেলিভিশন শো শুরু করি এবং আমার বিশ্বাস ছিল যে আমি সফল হব। প্রথম দিকে আমি প্রতিযোগিতার কথা ভেবে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমি নিজেই নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করি। যতটা সম্ভব কঠোর পরিশ্রম করি। তাই একসময় শীর্ষে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। অপরাহ উইনফ্রে শো ২১ বছর ধরে এক নম্বর অবস্থানে ছিল। এর সাফল্যে আমি খুবই খুশি ছিলাম। কিন্তু বছর খানেক আগে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে এবার নতুন করে কিছু শুরু করতে হবে। তাই আমি এই শো শেষ করে দিয়ে শুরু করলাম অপরাহ উইনফ্রে নেটওয়ার্ক, সংক্ষেপে ওউন। এর বছর খানেক পরে প্রায় সব গণমাধ্যমেই বলা হলো যে আমার এই উদ্যোগ ফ্লপ হয়েছে। কেবল ফ্লপ বললে ভুল হবে, মস্ত বড় রকমের ফ্লপ। সে সময়টাতে একদিন মি. ফস্ট আমাকে বললেন, হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে কিছু বলার জন্য। কিন্তু আমি ভাবছিলাম যে আমি তাদের উদ্দেশে কী বলব, যারা পৃথিবীর সবচেয়ে সফল গ্র্যাজুয়েট। আমার তো সফলতার মাত্রা কমতে শুরু করেছে। অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে লাগলাম। হঠাৎ পুরোনো দিনের একটা তত্ত্বকথা মনে পড়ল, ‘দুঃখ-কষ্ট সব সময় থাকে না, একসময় চলে যায়।’ আমার মনে হলো, হ্যাঁ, আমি অবশ্যই হার্ভার্ডে যাব এবং আমি আমার বিশ্বাসের কথা বলব।কতটা উঁচুতে তুমি উঠতে যাচ্ছ বা উঠতে পারবে, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব থাকে না। জীবনের কোনো না কোনো সময় তোমাকে হোঁচট খেতে হবে। তুমি যদি সারাক্ষণ নিজেকে ঠেলতে থাকো ওপরে তোলার জন্য, তুমি কোনো একটা সময় নিচে পড়ে যাবে। তবে যখনই এ রকম একটা অবস্থার মুখোমুখি হবে তখন মনে রেখো, ব্যর্থতার মতো আর কিছু নেই। জীবন যখন আমাদের অন্য দিকে চালানোর চেষ্টা করে, সেটাই ব্যর্থতা। আমরা যখন গর্তে পড়ে যাই, তখন সেটা আমাদের কাছে ব্যর্থতার মতো মনে হয়। তাই গত বছর আমি নিজেই নিজেকে বোঝাতে লাগলাম। গর্তে পড়ে যাওয়ার সময়টাতে সত্যিই ভীষণ খারাপ লাগে। কিছুটা সময় দাও তখন নিজেকে চিন্তা করার জন্য যে তুমি কী হারিয়েছ? তবে অবশ্যই এর সমাধান আছে। তোমার ভুলগুলো থেকে শেখার চেষ্টা করো। কারণ, প্রতিটি অভিজ্ঞতাই তোমাকে শেখাবে এবং তোমার নিজের শক্তি সম্পর্কে, তুমি উপলব্ধি করতে পারবে। পরবর্তী সঠিক পদক্ষেপটি কী হতে পারে, সেটা তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। নিজের ভেতরকার মূল মন্ত্র ও অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তখন সেটাই বলে দেবে যে কোন পথে তোমাকে যেতে হবে।
একটা ব্যাপার কি চিন্তা করেছ, এখন থেকে সব সময় যখনই তুমি তোমাকে গুগল করবে, তখন এর ফলাফলের মধ্যে থাকবে ‘হার্ভার্ড ২০১৩’। এখনকার সময়ের এই প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে এটা একধরনের কলিং কার্ড। এই দারুণ কলিং কার্ডটি ভবিষ্যতে তোমাদের জন্য চমৎকার বুলেট হিসেবে কাজ করবে, তা তোমরা আইনজীবী, সিনেটর, সিইও, বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অথবা টক শোর উপস্থাপক যা-ই হও না কেন।
আমার মনে হয় যে জীবনের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এমন একটা জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা, যেখানে তুমি কী হতে চাও, তাও বলবে। তুমি কী অর্জন করেছ, সেটা নয়, বরং তুমি কীভাবে অর্জন করেছ, তোমার জীবনের উদ্দেশ্য—এ সবকিছুর কথা বলবে। কেবল গৎবাঁধা একটা শিরোনাম ও কিছু কথা দিয়ে হবে না।
যখন তুমি পা পিছলে অন্ধকার গর্তে পড়ে যাবে, সে গল্পটাই তোমাকে সে অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসবে।
১৯৯৪ সালে আমি একজন ছোট্ট মেয়ের ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। সে মেয়েটি অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য চাঁদা আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে নিজে নিজেই হাজার ডলার পর্যন্ত জোগাড় করেছে। তখন আমার মনে হলো, যদি এই নয় বছরের মেয়েটি একটা ঝুড়ি ও বিশাল হূদয় নিয়ে এমন কাজ করতে পারে, তবে আমি কেন পারব না? তখন আমি দর্শকদের অনুরোধ করলাম, তাদের সাধ্যমতো সাহায্য করতে। ক্ষুদ্র্র ক্ষুদ্র সংগ্রহ একসময় তিন মিলিয়ন ডলার ছড়িয়ে গেল। এই টাকা থেকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি স্টেটের একজন করে শিক্ষার্থীকে সাহায্য করতে শুরু করলাম।
এখন যে ধারণাটা আমার কাছে বেশ স্বচ্ছ, আগে কিন্তু এমনটা ছিল না। আমি আগেও বলেছি যে আমি ১৯ বছর বয়স থেকে টিভির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ’৯৪ সালের দিকে আমি বুঝতে শুরু করলাম। তাই এমনটা ভাবা ঠিক না যে সবাই একসঙ্গে একই সময়ে সবকিছু বুঝতে পারবে। আমি বুঝতে পেরেছি যে আমি টেলিভিশন দিয়ে ব্যবহার হওয়ার জন্য না, বরং টেলিভিশনকে ব্যবহার করার জন্য এসেছি। এই শক্তিশালী মাধ্যমকে ব্যবহার করতে হবে আমাদের মানবীয় শক্তিগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
তোমাদের প্রত্যেকের ভেতরকার আলো তখনই চারদিক আলোকিত করবে যখন তোমরা চাইবে। মিসিসিপি গ্রামের এক ছোট্ট মেয়ে হিসেবে আমি তখনই বুঝেছিলাম, নিজের মতো হওয়া অনেক সহজ বারবারা ওয়ালটন হওয়ার চেয়ে।
জীবনে চলার পথে কখনো হতাশা আসতে পারে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সমস্যা দেখা দিতে পারে, নানা রকম প্রশ্নও আসতে পারে। কিন্তু তোমার মধ্যেই সেই সম্ভাবনা আছে, যা দিয়ে সব রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি তুমি দাঁড়াতে পারবে। সেই সত্যকে যদি উপলব্ধি করতে পারো, তখন তুমি নিজেই বুঝতে পারবে যে কোন কাজটা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে, তোমাকে সুখী করবে। আর এর মাধ্যমেই পৃথিবীতে তুমি তোমার পদচিহ্ন রাখতে পারবে। অভিনন্দন ২০১৩ সালের গ্র্যাজুয়েটদের।

সূত্র: ওয়েবসাইট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: মারুফা ইসহাক

ক্যারিয়ারে ১৪টি লাল কার্ড পেয়েছি! : জিনেদিন জিদান

৯৯৮ সালে ফিফা বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্সের তারকা ফুটবলার জিনেদিন জিদান ফ্রান্সের মার্সেইতে ১৯৭২ সালের ২৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন৷ জিদান ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার সম্মাননা লাভ করেছেন তিনবার, একবার ব্যালন ডি’অর৷ ২০০৬ সালে ফিফা বিশ্বকাপে তাঁর অনবদ্য নৈপুণ্যে ফ্রান্স ফাইনালে ওঠে, জিদান লাভ করেন গোল্ডেন বল।
জিনেদিন জিদানআমার বাবার কাছ থেকেই আমি সবকিছু শিখেছি। তাঁর কাছ থেকে শেখা সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, অন্যকে সম্মান দেওয়া। আমার বাবা আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সে আসেন, যা ছিল তাঁর জন্য দুঃস্বপ্ন। নতুন জায়গায় কাজের সন্ধান ও ফ্রান্সের সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছিল তাঁর জন্য বেশ কঠিন৷ নিজেকে প্রমাণ করার জন্য বাবাকে সব সময় সংগ্রামের মধ্যে থাকতে হতো। বাবা সেই কষ্টের গল্প থেকে আমাকে অনন্য একটা কথা শিখিয়েছিলেন। অন্যদের সম্মান অর্জনের জন্য আপনাকে সব সময় দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হবে। সম্মান আদায় করতে চাইলে অন্যদের সম্মান দিতে হবে। আমার বাবার এই শিক্ষা আমি আমার সন্তানদের দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
ছোটবেলায় আমার মনে হতো, আমি নিয়ম-শৃঙ্খলার জালে বন্দী। আমার শৈশব ছিল বেশ কঠিন, সবকিছু নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। কিন্তু এখন টের পাই, সেই কঠিন শৈশবের কারণেই আমি এখন জীবনের বড় বড় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারি খুব সহজে। বাবা আমার জন্য ছিলেন বাতিঘর। সেই বাতির আলো থেকে পাওয়া শিক্ষা আমার পুরো ক্যারিয়ারে প্রয়োগের আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।
যেকোনো পরিবারের জন্য বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি বড় ধরনের একটা সুবিধাও বটে। যেসব শিশুর বাবা-মা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন, সে শিশুরা ব্যতিক্রম হয়। তারা অন্যদের চেয়ে বেশি উদার হতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির ছোঁয়ায় তারা অনন্য হয়। আমার সন্তানদের দিকে তাকালে এটা সবাই বুঝতে পারবে।
আমি ছোটবেলায় রাস্তায় ফুটবল খেলতাম; যেখানে আমি খেলতাম সেরাদের সেরার মতো, আমার নিজের মতো। বল নিয়ে সেই দুরন্ত কৈশোর ছিল আমার জন্য স্মরণীয় এক সময়। তখনো আমি জানতাম না, ফুটবল খেলা খুবই মজার একটি কাজ।
জীবনে লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র চাবি হলো সাহস। নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য সাহসী হওয়ার বিকল্প নেই৷ সাহসীরা ব্যর্থ হয় না। কোনো কাজে ব্যর্থ হলে নতুন করে পথ খুঁজে নেয়। মানুষের জীবন অনেকটা বরফে চলা স্লেজ গাড়ির মতো—সব সময় দৌড়ের ওপর থাকে। কখনো কখনো পথ চলতে মনে হবে, আরে, কষ্ট ছাড়াই তো পর্বতের ঢাল বেয়ে নেমে সামনে যাওয়া যায়! কিন্তু সামনে যখন পর্বতের খাড়া অংশ হাজির হবে, তখন সেটা পার হতে আপনার সাহসই হবে আপনার একমাত্র সহায়, একমাত্র উপায়। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে তার সাহস।
আমার আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে ১৪টি লাল কার্ডের দেখা পাই, যার মধ্যে ১২টির একমাত্র কারণ ছিল রাগ। আমাকে যখন অন্যরা কথার মাধ্যমে রাগিয়ে তুলতে পেরেছে, তখনই আমি লাল কার্ডের দেখা পাই। এটা নিঃসন্দেহে গর্বের কোনো কারণ নয়। আমি আমার পক্ষে সাফাই গাচ্ছি না। আমার অন্যায় সহ্য করার ক্ষমতা কম, তাই আমি রেগে গিয়ে লাল কার্ড দেখার কাজ করতাম। যদিও আমি মাঠের বাইরের উল্টো। সাধারণ জীবনে আমি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকার চেষ্টা করি। আমি কাউকে কখনোই রাগানোর চেষ্টা করি না। কখনোই কারও সঙ্গে প্রতারণা করি না। সারা জীবন এই সাধনা করে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
আমি যখন নিজে বাবা হই, সেটা ছিল অন্য রকম অভিজ্ঞতা। আমি বড় আঙ্গিকে জীবনকে দেখার সুযোগ পাই। বাবা হওয়া মানেই সন্তানকে পড়াশোনা করার দায়িত্ব নয়। আপনি যা জানেন, জীবন সম্পর্কে যে ধারণা পেয়েছেন, তা আপনার সন্তানকে জানানো আপনার কর্তব্য। আমার জন্য ফুটবল খেলার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদের সময় দেওয়া ছিল বেশ কষ্টকর। কোনোটাই আপনি ছাড়তে পারবেন না। কি ফুটবল, কি সন্তান—দুটোই যে জীবন।
জীবনকে উপভোগ করতে চাইলে আপনার অতীতের বেশ কিছু ঘটনা ভুলে যেতে হবে। সেই ঘটনাগুলোয় আপনি হয়তো ছিলেন অন্যদের মতন; নিজেকে নিয়েই ছিল আপনার সব ব্যস্ততা আর সব ধান্দা। আপনার সব শক্তি অন্য সব সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয় করার মহান দীক্ষা নিতে হবে। সেই দীক্ষা পুরোপুরি আয়ত্ত করতে না পারলেও চেষ্টা করতে দোষ কী? সেই চেষ্টাটা সব সময়ই জাদুর মতোই অবিশ্বাস্য হয়। যতক্ষণ নিজেকে মানুষের ভালো করার জন্য বদলাতে পারবেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই চেষ্টা মনে হবে অলৌকিক কোনো গল্প।
সূত্র: ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের এস্কোয়ার ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে লিখেছেন জাহিদ হোসাইন খান

চাই সমালোচনা গ্রহণের শক্তি : কুমার সাঙ্গাকারা

কুমার সাঙ্গাকারা সম্প্রতি কলম্বো টেস্ট ম্যাচ খেলার মধ্য দিয়ে ইতি টানেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের। তাঁর জন্ম ১৯৭৭ সালের ২৭ অক্টোবর। উইজডেন তাঁকে ২০১১ ও ২০১৫ সালের লিডিং ক্রিকেটার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড তকমা দেয়। ১৩৪ টেস্টে ৩৮টি সেঞ্চুরিসহ সাঙ্গাকারার সংগ্রহ ১২ হাজার ৪০০ রান এবং ৪০৪ ওয়ান ডেতে ২৫টি সেঞ্চুরিসহ সংগ্রহ ১৪ হাজার ২৩৪ রান।


হতে হবে আশাবাদী: বিল গেটস

মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের অন্যতম। তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন এবং মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি মাইক্রোসফটের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে জনকল্যাণমূলক নানা কাজে যুক্ত আছেন।
বিল গেটসঅভিনন্দন, ২০১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা৷ মেলিন্ডা ও আমি আজ এখানে উপস্থিত হতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত৷ তোমাদের এই ক্যাম্পাস অনেক দিক থেকেই অসাধারণ৷ তবে আমাদের যদি একটি শব্দে বলতে হয় স্ট্যানফোর্ডের কোন বিষয়কে আমরা সবচেয়ে ভালোবাসি, তা হবে আশাবাদী মনোভাব৷
১৯৭৫ সালে এই আশা নিয়েই আমি বোস্টনের এক কলেজ ছেড়ে এসে কাজে নেমে পড়েছিলাম৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, কম্পিউটার ও সফটওয়্যার পৃথিবীজুড়ে মানুষের জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পারবে, পৃথিবীকে আরও অনেক উন্নত করে তুলবে৷ কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে৷ আমরা যা শিখেছি, আজ সেসব তোমাদের বলতে চাই৷ আর জানাতে চাই, কীভাবে আমরা সবাই আরও অনেক মানুষের জন্য অনেক কিছু করতে পারি৷
যখন পল অ্যালেন আর আমি মাইক্রোসফট শুরু করেছিলাম, তখন আমদের লক্ষ্য ছিল কম্পিউটার ও সফটওয়্যারের ক্ষমতাকে সাধারণ মানুষের কাজে লাগানো৷ ১৯৯৭ সালে আমি ব্যবসার কাজে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় যাই৷ একদিন আমি কৌতূহলবশত শহরের একটু দূরে সোয়েটো নামে একটা জায়গায় যাই; এমন জায়গা আমি জীবনে কখনো দেখিনি৷ মাইক্রোসফট সেখানে একটি কমিউনিটি সেন্টারে কম্পিউটার ও সফটয়্যার বিতরণ করেছিল, যেভাবে আমেরিকায় আমরা কাজ করতাম৷ কিন্তু আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুঝে গেলাম, এটা আমেরিকা নয়৷ এর আগে আমি দারিদ্র্যকে দেখেছিলাম পরিসংখ্যানে, নিজের চোখে নয়৷ সেখানে গিয়ে আমি দেখলাম, কীভাবে মানুষ বিদ্যুৎ, পানি, টয়লেট ছাড়াই বস্তিতে থাকছে৷ বেশির ভাগের পায়েই কোনো জুতা ছিল না, জুতা পায়ে হাঁটার মতো রাস্তাও ছিল না৷ যে কমিউনিটি সেন্টারে আমরা কম্পিউটার দান করেছিলাম, সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা ছিল না৷ তাই তারা ২০০ ফুট লম্বা তার দিয়ে ডিজেলচালিত একটি জেনারেটর থেকে বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়ে কম্পিউটার চালিয়ে রেখেছিল৷ অবস্থা দেখে আমি ভালোভাবেই বুঝলাম, যে মুহূর্তে আমি আর আমার সঙ্গের লোকজন চলে যাব, তৎক্ষণাৎ এই জেনারেটরও অন্য কোথাও চলে যাবে৷ আর কমিউনিটি সেন্টারের লোকেরাও তাদের জীবনের অন্য হাজার সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত হয়ে পড়বে; সেসব সমস্যা কখনো কম্পিউটার দিয়ে সমাধান করা যায় না৷
গণমাধ্যমের সামনে এসে আমি আগে থেকে তৈরি করে রাখা বক্তৃতা পড়ছিলাম৷ বলছিলাম, ‘সোয়েটো প্রযুক্তির বিভাজনকে ঘুচিয়ে দেওয়ার যাত্রায় একটি মাইলফলকের নাম৷’ কিন্তু মুখে যা-ই বলি, আমি বুঝতে পারছিলাম, এসব কথার কোনো অর্থ নেই৷ 
সোয়েটোতে যাওয়ার আগে আমি ভাবতাম, আমি পৃথিবীর সমস্যা বুঝি, কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো নিয়েই আমার কোনো ধারণা ছিল না৷ আমার এত অসহায় লেগেছিল যে আমি নিজের বিশ্বাসকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলাম, আদৌ কি উদ্ভাবনের মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব? আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, দ্বিতীয়বার আফ্রিকায় পা দেওয়ার আগে আমাকে বুঝতে হবে দারিদ্র্য আসলে কী৷
অনেক পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আমি একটি যক্ষা হাসপাতাল দেখতে গিয়েছিলাম৷ সেটি একটি বিশেষ ধরনের যক্ষা রোগীদের জন্য, যাদের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগেরও কম৷ গোটা হাসপাতাল রোগীদের ভিড়ে উপচে পড়ছে৷ রোগীদের মধ্যে আমি এক নারীর সঙ্গে কথা বললাম, তার বয়স মাত্র ত্রিশের কোঠায়৷ সে আগে এক যক্ষা হাসপাতালে কাজ করত, একদিন তার নিজেরও যক্ষা ধরা পড়ে, সঙ্গে এইডস৷ সে জানত, তার দিন ফুরিয়ে এসেছে৷ আর তার মৃত্যুর পর যখন সেই বিছানা খালি হয়ে যাবে, সেখানে জায়গা করে নিতেও রোগীদের এক বিশাল লাইন অপেক্ষা করে আছে৷ তারা অপেক্ষা করছে সেই দিনের৷
আমি গাড়িতে উঠে সেখানকার এক ডাক্তারকে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি জানি এ ধরনের যক্ষা সারিয়ে তোলা মুশকিল৷ কিন্তু কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয়ই আছে৷ এসব মানুষের জন্য আমাদের কিছু করতেই হবে৷’
আমি আজ আনন্দের সঙ্গে বলতে পারি এ বছর আমরা যক্ষার এক নতুন ধরনের ওষুধের পরীক্ষা করতে যাচ্ছি৷ আগে যেখানে ১৮ মাস ধরে প্রায় দুই হাজার ডলার খরচের পরও শতকরা ৫০ জনের বেশি রোগীকে সুস্থ করা যেত না, এখন সেখানে ছয় মাসের চিকিৎসায় ১০০ ডলারের কম খরচেই শতকরা ৮০ থেকে ৯০ জন রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হবে৷ এখানেই আশাবাদের শক্তি নিহিত৷ কে বলেছে আমরা দারিদ্র্য কিংবা রোগব্যাধিকে মির্মূল করতে পারব না? আমরা অবশ্যই পারব৷ সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন, আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে অনুপ্রেরণা জোগায়৷ কিন্তু সমস্যাকে নিজের চোখে না দেখলে শুধু আশা দিয়ে সমস্যা সমাধান করা যায় না৷
আমি হতাশাবাদীদের দলে নই৷ কিন্তু আমাদের স্বীকার করতে হবে যে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে যদি আমরা বৈষম্য দূরীকরণের কাজে না লাগাই, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা এমন সব উদ্ভাবন নিয়ে বসে থাকব, যা পৃথিবীকে আরও বিভক্ত করে ফেলবে৷ উদ্ভাবন দিয়ে কী হবে, যদি তা স্কুলে শিক্ষার মান না বাড়ায়? যদি ম্যালেরিয়া নির্মূল করা না যায়, দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব না হয়, দরিদ্র কৃষকের অন্নের নিশ্চয়তা না থাকে?
তোমরা স্নাতকেরা অসংখ্য উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেবে, পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে৷ তোমাদের বয়সে আমি পৃথিবীকে যতটা চিনতাম, আমি বিশ্বাস করি, আজ তোমরা তার চেয়ে অনেক বেশি জানো৷ আমি যা করেছি, তোমরা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করতে পারবে, যদি তোমরা এতে তোমাদের মনপ্রাণ ঢেলে দাও৷ আমি সেই প্রত্যাশায় রইলাম৷
সূত্র: স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট। 
১৫ জুন, ২০১৪ যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দেওয়া বিল গেটসের বক্তব্যের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার

মানুষ চিনতে হবে - ক্রিস গার্ডনার

ক্রিস গার্ডনার একজন আমেরিকান উদ্যোক্তা৷ গৃহহীন অবস্থা থেকে নিজের চেষ্টায় গড়ে তুলেছেন তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গার্ডনার রিচ অ্যান্ড কোম্পানি। তাঁর জীবনী অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দ্য পারস্যুট অব হ্যাপিনেস’ বিশ্বব্যাপী তুমুল প্রশংসিত হয়েছে। ২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে’তে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে ক্রিস গার্ডনার এই বক্তব্য দেন।
ক্রিস গার্ডনারপ্রথমেই আমি তোমাদের সঙ্গে যে কথাটা ভাগাভাগি করে নিতে চাই, সেটা হলো জীবনে তোমাদের সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার মোকাবিলা করতে হবে, সেটা হলো মানুষ। সেসব মানুষ, যাদের সঙ্গে বা যাদের জন্য তুমি কাজ করবে, তারা সব সময়ই চাইবে তোমাকে তোমার কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে। আজকের মতো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে তারা তোমাকে শিখিয়ে দেবে কী বলতে হবে, আর কীভাবেই বা তা বলতে হবে। সেদিন তোমাদের উচিত হবে, বিনয়ের সঙ্গে তাদের প্রত্যাখ্যান করা, এতে তোমাদের ভালো হবে।
আমি আজকের বক্তৃতার জন্য প্রথম পছন্দ ছিলাম না, হয়তো দ্বিতীয় পছন্দও না। কিন্তু সম্ভবত আমিই একমাত্র ব্যক্তি, যে তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছি। একই সঙ্গে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ে তোমাদের কাছে আসতে পারতাম। তোমাদের আমন্ত্রণ পাওয়ামাত্রই আমি তাতে সাড়া দিয়েছিলাম। তোমাদের অনেকে হয়তো জানো না, যখন ১৪ মাসের একটি শিশুকে ব্যাকপ্যাকে নিয়ে আমি কাজ করতাম৷ আমি ও আমার ছেলে তখন অনেক দিন এই ক্যাম্পাসে ঘুমিয়েছি। সে অবস্থান থেকে উঠে এসে আজকে যখন আমি এই মঞ্চে বক্তব্য দিচ্ছি৷ মনে হচ্ছে, আজকে যেন আমারও সমাবর্তন হচ্ছে। 
আরও অনেক কথা বলার আগে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই সেসব মা-বাবা ও আত্মার আত্মীয়দের, যাঁদের জন্য আজকে তোমরা এখানে। জীবনের বড় সাফল্যগুলো কেউ একা অর্জন করতে পারে না। আজকে তোমাদের প্রত্যেকে এখানে পৌঁছাতে পেরেছ, কেননা চলার পথে তোমাকে কেউ না কেউ সাহায্য করেছিল। আমি বিশেষ করে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার মতো সিঙ্গেল মা-বাবাকে। সেসব বাবাকে যাঁরা সন্তানের জন্য মা হয়েছেন এবং সেসব মাকে যাঁরা পালন করেছেন বাবার দায়িত্ব। আমাদের জীবনে সবচেয়ে ভালো কিছু হলো, আমাদের মা-বাবা। কিন্তু তাঁরা ছাড়াও তোমার সাফল্যের পেছনে নিশ্চয় অন্য কোনো ব্যক্তির অনুপ্রেরণা আছে। কোনো একসময়ে কেউ হয়তো তোমাকে বিশ্বাস করেছিল, তোমার মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা দেখেছিল, তোমাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছিল। সে ব্যক্তি তোমার ছোটবেলার শিক্ষক হতে পারেন, হাইস্কুলের কাউন্সিলর হতে পারেন অথবা হতে পারেন অতিসাধারণ একজন কর্মচারী। তুমি গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করো। ই-মেইল কোরো না, মেসেজ পাঠিয়ো না, ফোন কোরো না—তাঁর সামনে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরো, তাঁর সঙ্গে হাসো, তাঁর হাত ধরে কাঁদো; তোমার ভালো লাগবে। আর যাঁরা বলেছিল তোমাকে দিয়ে হবে না, তুমি পারবে না; তাঁদের গিয়ে জিজ্ঞাসা করো তোমার সম্পর্কে এখন তাঁদের কী অভিমত। 
আমি যখন নিজের ভাবনাগুলোকে সাজিয়ে নিচ্ছিলাম তোমাদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য, আমি ভাবছিলাম তোমাদের জায়গায় আমি হলে কী শুনতে চাইতাম। দেশের অর্থনীতির অবস্থা, ওয়াল স্ট্রিটের হালচাল নাকি চাকরির বাজারের খবর? না, এর কোনোটিই আমি জানতে চাইতাম না। আমি জানতে চাইতাম একজন আমেরিকান হিসেবে আমাদের স্বপ্নের কথা, পূর্বপ্রজন্ম যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এ দেশের জন্য কাজ করেছেন তার কথা। আমি জানতে চাইতাম যে আমাদের চেক ইন অ্যাকাউন্টের ব্যালান্সের চেয়ে আমাদের জীবনের ভারসাম্য অধিক জরুরি। জীবনে প্রার্থনার চেয়ে প্রশংসা অনেক বেশি দরকারি। আমি চাইতাম যাতে সমাবর্তন বক্তা আমাদের বলেন, বস্তুর আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখাটা বোকামি৷ কারণ, আমাদের একসময় ফিরে আসতে হবে পরিবার ও পরিজনদের কাছে। আমি তোমাদের জানাতে চাই যে তুমি কী করো, সেটা দিয়ে নিজেকে বিচার কোরো না । নিজের মোট আর্থিক সম্পদ দিয়ে মানবিক শক্তির তুলনা টেনো না। তোমার চারপাশে তুমি অনেক জিনিস দেখতে পাবে, কিন্তু জেনে রেখো সুখী হওয়ার জন্য তোমার এর কোনোটিরই প্রয়োজন নেই। 
তোমাদের জন্য এটাই আমার স্বপ্ন, যার ভিত্তি প্রোথিত আছে অতীতে, এটা বর্ণিত হচ্ছে বর্তমানে কিন্তু এর লক্ষ্য সুদূর অতীত ঘিরে। তোমরা আজকে বৃহৎ এক পৃথিবীতে পা রাখতে যাচ্ছো। তোমরা যা-ই করো না কেন, সব সময়ই সুখের সন্ধান করো। সুখী হও। 
সবাইকে ধন্যবাদ।

সফল হওয়ার পূর্বশর্ত ‘পাগল’ হওয়া - শাহরুখ খান

১৬ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন ভারতীয় অভিনেতা শাহরুখ খান। সেখানেই শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তব্য রেখেছেন তিনি

ডক্টরেট ডিগ্রি আমার জন্য নিশ্চয়ই একটা সম্মানজনক ব্যাপার। আমি যে পেশায় আছি, সেখানে ‘সবিনয়ে’ শব্দটা প্রায়ই ব্যবহার হয়। এ ধরনের ‘কপট তোয়াজ’ আমার ঠিক পছন্দ না, তাই এই শব্দটা আমি ব্যবহার করছি না। তবে এটুকু বলতে পারি, এ রকম অনুষ্ঠানগুলোই আমাকে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করে। এই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে আমি কিছু নির্দেশনাও পেয়েছি। আমাকে বলা হয়েছে ‘সাফল্য’ সম্পর্কে ‘পরামর্শ’ দিতে!জীবন সম্পর্কে আমি যা কিছু শিখেছি, তার বেশির ভাগই চলচ্চিত্র থেকে পাওয়া।আমার ক্যারিয়ারের প্রথম দিককার একটি চলচ্চিত্রের নাম দিওয়ানা (হিন্দিতে দিওয়ানা শব্দটা প্রেম-সংক্রান্ত কিংবা ভালো কিছুর নেশায় ‘পাগলামি’ অর্থে ব্যবহার করা হয়।) এই চলচ্চিত্র থেকে আমি যা শিখেছি, জীবনে সুখী ও সফল হওয়ার পূর্বশর্ত হলো ‘পাগল’ হওয়া। ভেব না জীবনের ছোট ছোট খ্যাপাটে ভাবনাগুলো তোমার জন্য এতটাই ক্ষতিকর যে সারা জীবন এসব চিন্তাকে চেপে রাখতে হবে। পাগলামিগুলোকে স্বীকার করে নাও, আর সেটাকেই নিজের জীবন গড়তে কাজে লাগাও। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে প্রতিভাবান মানুষ, যাঁরা বিপ্লব করেছেন, যাঁরা উদ্ভাবন করেছেন, আবিষ্কার করেছেন, তাঁরা পেরেছেন কারণ তাঁরা নিজের মানসিক গঠনকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। ‘স্বাভাবিক’ বলে কিছু নেই। এটা কেবল ‘প্রাণহীন’ এর প্রতিশব্দ!দিওয়ানার পরপরই আমি চমৎকার নামে একটা ছবিতে অভিনয় করেছি, যেখানে আমার চরিত্রটা একজন দুর্ভাগা নায়কের। হিন্দিতে ‘চমৎকার’ শব্দের অর্থ সহজ কথায় ‘মিরাকল’ বা কোনো অলৌকিক ঘটনা। এই ছবি থেকে আমার শিক্ষা অনেকটা এমন: ধোঁকায় পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে হঠাৎ একদিন যদি আবিষ্কার কর, তুমি একটা গর্তের ভেতর ঘুমিয়ে আছ, ভয় পেয়ো না। নিশ্চয়ই অদূরেই কোনো ‘মিরাকল’ অপেক্ষা করছে। সেই ‘মিরাকল’ কোনো ভূতও হতে পারে! তোমার কাজ হলো চুপচাপ শুয়ে থাকা। একটু অন্যভাবে বললে, ‘বেঁচে থাকা’ই হলো সেই অলৌকিক ঘটনা যার জন্য তুমি অপেক্ষা করছ। তোমার যা কিছু আছে, সব কাজে লাগাও। মনের জোর, আশপাশের মানুষকে ভালোবাসার ক্ষমতা, সুস্বাস্থ্য, সৌভাগ্য...যত উপহার জীবন তোমাকে দিয়েছে তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার কর। জীবনকে শ্রদ্ধা কর। জীবনের প্রতিটা উপহার, প্রতিটা মুহূর্তকে নষ্ট হতে না দিয়ে কাজে লাগাও। সাফল্যের কোনো মাপকাঠি নেই কিন্তু জীবন তোমাকে যা কিছু দিয়েছে তার পুরোটা কাজে লাগানোর সুযোগ তোমার আছে।তুমি জানো না, ভবিষ্যতে তোমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। জানো না ‘আগামীকাল’ বলে কিছু আছে না নেই। কাল হো না হো নামের একটা ছবিতে আমি একেবারে তরুণ বয়সে মারা যাই। এই ছবির মূল কথাও সেটাই। আমি কখনোই আমার দুই বড় সন্তানকে এই ছবিটা শেষ পর্যন্ত দেখতে দিইনি। এমনকি আমরা ছবির অন্য রকম একটা সমাপ্তি তৈরি করেছিলাম শুধু ওদের জন্য। কিন্তু এখন ওরা তোমাদের মতো বড় হয়েছে। শিগগিরই নিজের জীবনে নিজের মতো করে একটা চমৎকার যাত্রা শুরু করবে। আমি ওদের এই রোমাঞ্চ থেকে আগলে রাখতে চাই না। বরং আমার অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যতটা সম্ভব ওদের বলতে চাই, এই সময়টাতেই যা পার করে নাও।
মুহূর্তে বাঁচ। আজকে বাঁচ। চঞ্চল চোখে তুমি হয়তো দেখতে পাচ্ছ না। কিন্তু এটাই কাজে লাগানোর শ্রেষ্ঠ সময়। আমি তোমাদের সবাইকে শুধু এটুকুই বোঝাতে চাই, এই সময়টা তোমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পড়ালেখা কর। কষ্ট কর। নিয়ম দিয়ে নিজেকে বেঁধে রেখ না। কখনো কাউকে দুঃখ দিয়ো না...আর কখনোই অন্যের স্বপ্নে বেঁচ না। যতবারই ভুল কর না কেন, হেরে যাও না কেন, যতই মনে হোক না কেন সারা দুনিয়া তোমার বিপক্ষে, একটা কথা মনে রেখ—বব মার্লের ভাষায় যদি বলি, ‘...অ্যাট দ্য অ্যান্ড এভরিথিংস গনা বি অলরাইট’ (দিন শেষে সব ঠিক হয়ে যাবে)। আর আমার ভাষায় যদি বলি, জীবনটা হিন্দি সিনেমার মতো। শেষে গিয়ে সব ঠিক হয়ে যায়। আর যদি ঠিক না-ও হয়, তাহলে বুঝতে হবে ‘শেষ’ এখনো আসেনি। কারণ ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরি দোস্ত!’ (কাহিনি এখনো শেষ হয়ে যায়নি বন্ধু) এটাকেই জীবনের একমাত্র সত্যি হিসেবে মেনে নাও।
তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: মারুফ ইসলাম