Showing posts with label প্রেরণামূলক. Show all posts
Showing posts with label প্রেরণামূলক. Show all posts

Saturday, September 8, 2018

জ্যাক ডরসির সাফল্যের ১০ সূত্র




জ্যাক ডরসি
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান টুইটার ও স্কয়ারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জ্যাক ডরসি। পড়ুন তাঁর সাফল্যের রহস্য

১ ভাবনা থেকে শুরু হোক

জ্যাক ডরসি মনে করেন, উদ্যোক্তাদের সম্পর্কে অনেকেরই একটা ভুল ধারণা আছে। আমি নিজেই নিজের ‘বস’ হতে চাই, অতএব একটা ‘আইডিয়া’ খোঁজা শুরু করলাম...ব্যাপারটা এমন নয়। উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা থেকে ‘আইডিয়ার’ জন্ম হয় না, বরং ‘আইডিয়া’ থেকেই একজন উদ্যোক্তার জন্ম হয়। ডরসি বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে একজন ভাবল, আমি একটা ব্যবসা করতে চাই, তা নয়। বরং ঘুম থেকে উঠে কেউ যদি ভাবে, অমুক বিষয়টায় আমার ভীষণ আগ্রহ, আমি যেকোনো মূল্যে এটা নিয়ে কাজ করতে চাই, তাহলেই একটা সফল ব্যবসার জন্ম হবে।’

২ প্রতিষ্ঠানে থাকুক স্বচ্ছতা

স্কয়ারের মূল কার্যালয়ে একটা নিয়ম সব সময় মানা হয়। যেকোনো মিটিংয়ের সারাংশ একজন টুকে নেন, এরপর সিদ্ধান্তগুলো প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কর্মীকে ই-মেইলের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য হলো; আমরা কী করছি, কেন করছি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী—এসব ব্যাপারে যেন সবার সমান ধারণা থাকে। ডরসি বলেন, ‘এর মাধ্যমে আমরা আরও অনেক নতুন নতুন আইডিয়া পাই, ভিন্ন চোখে দেখার সুযোগ পাই। ফলে ভিন্নভাবে ভাবার সুযোগ হয়। প্রতিষ্ঠানে সৃজনশীলতার চর্চা গড়ে ওঠে।’

৩ সঠিক সময়টা কাজে লাগান

টুইটারের ভাবনা প্রথম জ্যাক ডরসির মাথায় এসেছিল ২০০০ সালে। তখনো লেখার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার ধারণা জনপ্রিয়তা পায়নি। একজন আমেরিকান সে সময় গড়ে মাসে ৩৫টি খুদে বার্তা লিখত। ভ্যানিটি ফেয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জ্যাক ডরসি বলেছেন, ‘তখনো বার্তা পাঠানোর জন্য মোবাইলের ব্যবহার ততটা জনপ্রিয় ছিল না, অতএব আমি ভাবনাটা বাস্তবায়নের জন্য ব্যস্ত হইনি।’ ২০০৬ সালের জরিপে দেখা গেল, আমেরিকানরা আরও বেশি ‘টেক্সট’নির্ভর হয়ে পড়ছে। তারা ফোনকলের চেয়ে বেশি খুদে বার্তা ব্যবহার করছে। জ্যাক ডরসি বুঝলেন, এটাই সময়! ২০০৬ সালের জুলাই মাসে যাত্রা শুরু করল টুইটার। এরপরের সাফল্যের গল্প সবার জানা।

৪ ক্যারিয়ার পথ সরলরেখার মতো নয়

টুইটারের যাত্রা শুরুর আগে ফ্যাশন স্কুলে জামার নকশা তৈরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন ডরসি। ‘ইলাস্ট্রেটর’ হিসেবে ক্যারিয়ার মোটামুটি প্রতিষ্ঠিতই ছিল। তাহলে প্রোগ্রামিং আর এই নতুন ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হলেন কেন? ফোর্বস সাময়িকীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আগে যা করেছি, সেগুলো ছিল নিজেকে তৈরি করার প্রক্রিয়ামাত্র।’ ব্যবসায়ী হিসেবেই যে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান, তা নয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নিউইয়র্কের মেয়র হওয়ার স্বপ্ন তাঁর।

৫ রুটিন অনুসরণ করুন

ছকে বাঁধা জীবন পছন্দ করেন জ্যাক ডরসি। প্রতিদিন সকালে দুটো সেদ্ধ ডিম আর একটুখানি ফল নাশতার টেবিলে থাকা যেমন তাঁর নিয়ম, তেমনি অফিসের কাজগুলোও একেবারে নিয়মে বেঁধে নিয়েছেন। সোমবার স্কয়ার এবং টুইটার পরিচালনাবিষয়ক সভা, মঙ্গলবারে পণ্য, প্রকৌশল, নকশাবিষয়ক আলোচনা, বুধবারে বিপণন ও যোগাযোগবিষয়ক সভা, বৃহস্পতিবারে প্রতিষ্ঠানের অংশীদার ও ডেভেলপারদের সঙ্গে সময় কাটানো, শুক্রবারে প্রতিষ্ঠানের রীতিনীতিবিষয়ক আলোচনা—পুরো সপ্তাহের রুটিন তাঁর করাই আছে। তিনি স্রেফ রুটিন অনুসরণ করেন।

৬ সহজ ও সুন্দর

টুইটারে ২৮০ বর্ণের মধ্যে মনের কথা বর্ণনা করতে হয়। উদ্দেশ্য হলো, যে কথাটা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই যেন আপনি স্পষ্ট করে বলতে পারেন। বাড়তি কথা ছেঁটে ফেলার এটা একটা উপায়। ব্যক্তিগতভাবে জ্যাক ডরসিও এই নীতিতে বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, ‘যা আমি বলতে চাই বা যে কাজ করতে চাই, আমার নজর যেন শুধু সেদিকেই থাকে।’ আপনার কাছে টুইটারের অর্থ কী? মাত্র এক শব্দেই সেটা বলে দিতে পারেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা—‘যোগাযোগ’। অল্প কথাই তাঁর কাছে সহজ ও সুন্দর।

৭ ডায়েরি রাখুন

হাইস্কুল জীবন থেকেই নিজের অর্জন, ব্যর্থতা, কর্মকাণ্ডগুলো ডায়েরিতে টুকে রাখতেন জ্যাক ডরসি। তাঁর মতে, এটা তাঁর জীবনের সেরা কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। ডরসি বলেন, ‘নিজের উন্নতির দিকে লক্ষ রাখার জন্য এটা সবচেয়ে সহজ উপায়। কীভাবে আপনি, আপনার ব্যবসা, আপনার নেতৃত্বগুণ একটু একটু করে পরিণত হয়েছে, আপনি সেটা চোখের সামনে দেখতে পাবেন।’

৮ যোগাযোগ আর সহযোগিতাই মূল চাবি

ডরসি বলেন, আপনার প্রতিষ্ঠানের দুটো বিভাগ কিংবা দুটো মানুষ যদি পরস্পরের সঙ্গে কথা না বলে, মিলেমিশে কাজ না করে, তাহলে একটা ফাঁক থেকে যায়। এই ঘাটতির প্রতিফলন থাকবে আপনার পণ্যেও। অতএব সেটা গ্রাহকের দৃষ্টি এড়াবে না। ডরসির বক্তব্য, ‘পণ্যের নকশা বা সেবা প্রদানের কৌশলের ব্যাপারে আমরা যতটা সতর্ক, একই রকম গুরুত্ব পায় আমাদের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাও।’

৯ ছুটির সর্বোত্তম ব্যবহার করুন

অনেকে মনে করে, ছুটির দিনগুলোয় কাজ করা মানেই হলো আরেকটু এগিয়ে থাকা। কিন্তু অনেক সফল মানুষই বোধ হয় এ কথার সঙ্গে একমত নন। জ্যাক ডরসি বলেন, ‘শনিবার আমার ছুটির দিন। এই দিন আমি সব রকম দাপ্তরিক কাজ থেকে দূরে থাকি। রোববার থেকে আমার পুরো সপ্তাহের কাজের জন্য তৈরি হই।’ ছুটির দিনে যেমন পুরো দিনটা উপভোগ করেন, তেমনি কাজের বেলায় কোনো ছাড় দেন না ডরসি। সপ্তাহের ছয় দিন দুই প্রতিষ্ঠানে আট ঘণ্টা করে সময় দেন।

১০ দ্বিধা ঝেড়ে কাজে হাত দিন

টুইটারের শুরুর দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলছিলেন জ্যাক ডরসি। ‘নতুন কোনো ভাবনা মাথায় এলে আপনার মাথায় অনেকগুলো “যদি” খেলা করবে। যদি এটা হয়, যদি ওটা হয়...এসব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে কাজে হাত দিন। যত দ্রুত আপনি কাজ শুরু করবেন, তত দ্রুতই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবেন।’


সূত্র: নো স্টার্টআপ

Wednesday, April 4, 2018

শেরিল স্যান্ডবার্গ,ফেসবুকের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা



ফেসবুকের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গ। টাইম সাময়িকীর করা বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী মানুষের তালিকায় আছে তাঁর নাম। গত ১২ মে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অ্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটির (ভার্জিনিয়া টেক) সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি



দুই বছর এগারো দিন আগে আমি আমার স্বামী ডেভকে হারিয়েছি। আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিতভাবে। ওর কথা বলতে গেলে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়। কারণ, আমি এখনো ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়ও ভেবেছিলাম, দিনটা আর দশটা দিনের মতোই কাটবে। অথচ ওই এক দিনেই আমার জীবনটা বদলে গিয়েছিল।


আমি জানি, আজ তোমাদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাইরে সুন্দর বৃষ্টি পড়ছে। আর আমি কি না এখানে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর কথা বলছি। এর পেছনে একটা কারণ আছে। কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদের মন খারাপ করিয়ে দেব না।


ডেভের মৃত্যুর পর পৃথিবীর প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। সে কথাই আজ তোমাদের বলব। কারণ, আমার বিশ্বাস, আমার অভিজ্ঞতা তোমাদের একটা সুস্থ-সুন্দর জীবনের দিকনির্দেশনা দেবে। আজ এখানে পৌঁছানোর পেছনে তোমাদের প্রত্যেকের নিশ্চয়ই বিচিত্র সব গল্প আছে। কেউ কেউ প্রচণ্ড মানসিক চাপের মুখোমুখি হয়েছ। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা তোমাদের হয়েছে। হতাশা, মানসিক যন্ত্রণা, হারানোর ব্যথা, অসুস্থতা—এ সব অনুভূতি খুব ব্যক্তিগত, কিন্তু সর্বজনীন। কিছু কিছু ব্যথা আবার একার নয়। ভার্জিনিয়া টেকের শিক্ষার্থীরা খুব ভালো করে সেটা জানে। আজ সকালে ড্রিলফিল্ডের ‘থার্টি টু হকি স্টোন’-এর সামনে দিয়ে আসার সময় আমি যেমন মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছিলাম, তোমরাও নিশ্চয়ই তা-ই করো। (২০০৭ সালের ১৬ এপ্রিল আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ভার্জিনিয়া টেকের ৩২ জন শিক্ষার্থী। তাঁদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২টি স্মৃতিস্তম্ভ আছে—বি.স.) তোমরা জানো, এক মুহূর্তের মধ্যে জীবনটা বদলে যেতে পারে। তোমরা জানো, এই সময়ে সবার একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হয়, শোক অনুভব করতে হয়, নিজেদের টেনে তুলতে হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে হয়।


আমাদের সবারই একটা দল প্রয়োজন। বিশেষ করে তখন, যখন জীবন আমাদের সামনে বাধার দেয়াল তুলে দেয়। ভার্জিনিয়া টেকের বাইরেও তোমরা একেকটা দলের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই দলটাই সাহায্যের প্রয়োজন হলে এগিয়ে আসবে। আমার জন্য অবশ্য একটা দলের অংশ হওয়া খুব কঠিন ছিল। ডেভের মৃত্যুর আগে আমি আসলে মানুষকে বিরক্ত করতে চাইতাম না। হ্যাঁ, আমার কাছে ব্যাপারটা ‘বিরক্ত করা’ই মনে হতো। কিন্তু ডেভ চলে যাওয়ার পর সব বদলে গেল। কখনো ভাবিনি পরিবার, বন্ধু আর সহকর্মীরা আমার জীবনে এতটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।


তোমাদের মধ্যে কেউ কি ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছ? ভাবছ ভাগ্য তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মাঝেমধ্যে আমারও এমন ভয় হয়। এই ভয়ের বিরুদ্ধে তুমি কী নিয়ে লড়বে জানো? আশা—ছোট্ট একটা শব্দে লুকিয়ে আছে অনেক বড় ভাবার্থ।


আমরা ভাবি ‘আশা’ প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পদ। কিন্তু ‘ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতার’ পাশাপাশি আশাও কিন্তু দলগতভাবে গড়ে উঠতে পারে। দুই দিন আগে আমি চার্লসটনের মাদার ইমানুয়েল চার্চে গিয়েছিলাম। আমরা সবাই জানি দুই বছর আগে সেখানে গোলাগুলিতে একজন যাজক এবং আটজন ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এরপর যা ঘটেছে তা সত্যিই অনন্য। ঘৃণার বদলে সেখানকার সব মানুষ ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা একসঙ্গে বর্ণবাদ ও হিংস্রতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। স্থানীয় যাজক জারমেইন ওয়াটকিনস যেমন খুব সুন্দর করে বলেন, ‘ঘৃণাকে বলি—না, আজকের দিনটা তোমার নয়। বিভেদকে বলি—না, আজকের দিনটা তোমার নয়। আশাহীনতাকে বলি—না, আজকের দিনটা তোমার নয়।’


ফেসবুকে আমি অনেকের লেখাই পড়ি। কিন্তু প্যারিসের সাংবাদিক অ্যান্টয়েন লেইরিসের একটা লেখা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। তাঁর স্ত্রী হেলেন ২০১৫ সালে প্যারিস হামলায় নিহত হয়েছিলেন। এর মাত্র দুই দিন পর লেইরিস তাঁর স্ত্রীর হত্যাকারীদের উদ্দেশে একটা খোলা চিঠি লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘শুক্রবার রাতে তোমরা কেড়ে নিয়েছ একজন অন্য রকম মানুষকে, আমার ভালোবাসাকে, আমার সন্তানের মাকে। কিন্তু আমার ঘৃণা তোমরা পাবে না। আমার ১৭ মাস বয়সী ছোট্ট ছেলেটা একজন সুখী, স্বাধীন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবে, প্রতিদিন সে হাসবে খেলবে আর তোমাদের বুড়ো আঙুল দেখাবে। কারণ, তার ঘৃণাও তোমরা পাবে না।’


এ রকম অসামান্য শক্তি আমাদেরও শক্তি দেয়। এমন আশা আমাদের মনেও আশা জাগায়। এভাবেই আমরা একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াই, একে অপরকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করি।


ক্যাম্পাস ছেড়ে তোমরা বাইরের পৃথিবীতে পা রাখতে যাচ্ছ। আমি তোমাদের বলতে চাই, যেকোনো পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নিজের মধ্যে গড়ে তোলো। শোক কিংবা হতাশা যখন আঘাত করে, নিশ্চিত থেকো, খুব গভীরে সেটা কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা তোমার আছে।


দুই বছর আগে কেউ যদি আমাকে বলত, ‘ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়েও তুমি জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে’—আমি কখনোই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এখন সত্যিই তাই হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞ আমার সন্তানদের জন্য, আমার পরিবারের জন্য, আমার বন্ধু, কাজ আর এই জীবনটার জন্য।


কিছুদিন আগে আমার কাজিন লরার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। স্নাতকেরা, জীবনের ৫০টা বছর যে কী দ্রুত কেটে যায় আর তখন যে নিজেকে কতটা বৃদ্ধ মনে হয়, এই অনুভূতি তোমরা বুঝবে না। তোমাদের মা-বাবা নিশ্চয়ই বোঝেন। লরাকে ফোন করে আমি বলেছিলাম, ‘শুভ জন্মদিন লরা। শুধু এ কথা বলার জন্যই আমি তোমাকে ফোন করিনি। তুমি হয়তো সকালে ঘুম থেকে উঠেই ভাবতে বসেছ, “হায়, বয়সটা ৫০ ছুঁয়ে ফেলল!” সে ক্ষেত্রে আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এভাবে ভেব না। মনে রেখ, এ বছর তুমি যেমন ৫০ ছুঁয়েছ, ডেভ বেঁচে থাকলে ওর বয়সও ৫০ হতো। ডেভ পারেনি, তুমি তো পেরেছ।’ বুড়ো হই বা না হই, বয়স কোনো কৌতুকের বিষয় নয়। প্রতিটা বছর, প্রতিটা মুহূর্ত...এমনকি এই যে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে...এটাও জীবনের একটা উপহার।


নতুন বছরে আমার প্রতিজ্ঞা ছিল, ঘুমাতে যাওয়ার আগে দিনের তিনটি আনন্দের মুহূর্ত আমি লিখে রাখব। এই সহজ অভ্যাস আমার জীবন বদলে দিয়েছে। আগে প্রতি রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবতাম, কত কী ভুল করলাম, আগামী দিন না জানি কত ভুল করতে যাচ্ছি। এখন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভাবি, আজ কী কী পেলাম। দারুণ সব মুহূর্তের স্মৃতি দিয়ে আমার নোটবুক ভারী হয়ে উঠছে। তোমরাও চেষ্টা করে দেখতে পারো, আজই শুরু করো। আজকের দিনটাতে নিশ্চয়ই লেখার মতো অনেক কিছু তুমি পাবে।


আর হ্যাঁ, আজ রাতে আমার দিনের সেরা তিন মুহূর্তের মধ্যে আমি তোমাদের কথাও লিখব। লিখব, তোমরা আমার মধ্যে আশা আর ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চার করেছ।


অবশেষে আমি যে আমার লম্বা বক্তব্যটা শেষ করতে যাচ্ছি, তোমরাও এই আনন্দের মুহূর্তটার কথা লিখে রাখতে পারো (হাসি)। পুরো পৃথিবী তোমাদের অপেক্ষায় আছে। এই অপার সম্ভাবনাকে তোমরা কীভাবে কাজে লাগাও, দেখার জন্য আমি মুখিয়ে আছি।


অভিনন্দন আবারও। (সংক্ষেপিত)


ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ


সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

Sunday, April 1, 2018

ইলন মাস্কের সাফল্যের ১০ সূত্র


ইলন মাস্ক

রকেট নির্মাণপ্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক। টেসলা, পেপ্যালসহ আরও বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। গত ফেব্রুয়ারিতে স্পেসএক্সের তৈরি রকেট ফ্যালকন হেভির সফল উৎক্ষেপণের পর তুমুল আলোচিত হয়েছেন তিনি। পড়ুন তাঁর সাফল্যের সূত্র

১. স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান সমালোচনা


চাকরি বা ব্যবসা—আপনি যা-ই করেন না কেন, নিশ্চয়ই কোনো না কোনো পণ্য তৈরি করছেন। আপনার পণ্যটাকে নিখুঁত করতে হলে মানুষের প্রতিক্রিয়া জানা প্রয়োজন। দুর্বল লোকেরা সমালোচনায় হতাশ হয়ে পড়েন। আর মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা সমালোচনাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে উন্নত করেন। মানুষের প্রতিক্রিয়া তাঁরা মন দিয়ে শোনেন। বোঝার চেষ্টা করেন, এই প্রতিক্রিয়ার কতখানি সত্য। ভাবেন, কোথায় কোথায় নিজেকে আরও উন্নত করা যায়। এই বিশ্বাস থেকেই সমালোচনাকে ভালোবাসেন ইলন মাস্ক। তিনি বলেন, ‘আপনি যা-ই করেন না কেন, একজন সুবিবেচকের সমালোচনা আপনার কাছে স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান।’ বটে, সমালোচকেরাই তো আপনার ভুল ধরিয়ে দেবে!

২. হার মানতে নেই


যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টিভি চ্যানেল সিবিএসের একজন সাংবাদিকের সঙ্গে ইলন মাস্কের কথোপকথনের একটি অংশ শুনুন।

: আপনি যখন পরপর তিনবার ব্যর্থ হলেন, হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি?

: কখনো না।

: কেন?

: আমি কখনোই হার মানিনি। মৃত্যু এলে কিংবা একেবারে অক্ষম হয়ে গেলে তবেই কেবল আমি হার মানব।

ইলন মাস্কের কথা যে কেবল কথার কথা নয়, তাঁর পেছনের দিনগুলোতে তাকালেই বোঝা যায়। স্পেসএক্স থেকে ফ্যালকন ১ নামের রকেটটি উৎক্ষেপণ করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হাল ছাড়েননি।

৩. প্রচারের চেয়ে উন্নয়ন জরুরি


অনেকে প্রতিষ্ঠান প্রচারের জন্য যত টাকা ব্যয় করে, পণ্যের মান উন্নয়নের জন্য ততটা ব্যয় করতে আগ্রহী হয় না। টেসলা সম্পর্কে মাস্কের বক্তব্য, তারা কখনোই বিজ্ঞাপনের জন্য তেমন খরচ করেনি, যতটা পণ্যের উন্নয়নের জন্য করেছে। এই মনোভাব শুধু যে সময়, শক্তি ও অর্থ বাঁচায় তা নয়, দ্রুত সামনে এগোতেও সাহায্য করে। মাস্ক বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠান দ্বিধায় পড়ে যায়। তারা এমন সব খাতে টাকা ব্যয় করে, যেগুলো তাদের উৎপাদনকে উন্নত করে না।’ এমন ব্যয় মোটেও কোনো কাজের নয় বলে মনে করেন এই উদ্যোক্তা।

৪. জীবন হোক রোমাঞ্চকর


ইলন মনে করেন, জীবনটা খুব ছোট। আপনি যে কাজটা পছন্দ করেন না, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই একই কাজ করার কোনো মানে হয় না। বেরিয়ে পড়ুন, পাহাড়ে চড়ুন, বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান...রোমাঞ্চ উপভোগ করুন। আপনি তো রোবট নন। ইলন বলেন, ‘মঙ্গলে বসতি গড়ার কল্পনা আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে। প্রতিদিন কিছু সমস্যা সমাধানের চাইতে জীবনটা অনেক বড়। অতএব, জেগে উঠুন আর ভবিষ্যতের কল্পনায় রোমাঞ্চিত হোন।’

৫. যতটা সম্ভব পরিশ্রম করুন


পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। হোক সেটা মানসিক কিংবা শারীরিক—একমাত্র পরিশ্রমের মাধ্যমেই আপনি সফলতা অর্জন করতে পারেন। পরিশ্রম প্রসঙ্গে ইলন মাস্ক বলেন, ‘কেউ সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করছে আর আপনি হয়তো ১০০ ঘণ্টা কাজ করছেন। আপনারা দুজন হয়তো একই কাজ করছেন। নিশ্চিত থাকুন, অন্য মানুষটি যেটা এক বছরে অর্জন করবে, সেটা আপনি মাত্র চার মাসেই অর্জন করতে পারবেন।’ তবে কাজের সঙ্গে শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা থাকাটাও প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন তিনি।

৬. ভালোবাসার ক্ষেত্রটিতেই কাজ করুন


ইলন মাস্ক বলেন, যে কাজটি আপনি করছেন সেটাকে ভালোবাসা খুব জরুরি। যদি তা না হয়, তাহলে মনে হবে, আপনি নিজের ওপর জোর খাটাচ্ছেন। এভাবে হয়তো কিছুদিন চলতে পারবেন। কিন্তু যখন কঠিন সময় আসবে, তখন আর সামলাতে পারবেন না। অতএব, সেই কাজই বেছে নিন, যেটা আপনি সহজাতভাবেই পছন্দ করেন। হোক সেটা গান, গণিত কিংবা মহাকাশবিদ্যা। অনেকেই নিজের ভালো লাগার জায়গাটা ধরতে পারেন না। দ্বিধায় ভোগেন। এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরুন, লক্ষ করুন, কোন কাজটিতে আপনি সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছেন। নিজেকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন। শিগগিরই পছন্দের জায়গাটা ধরতে পারবেন। ইলন বলেন, ‘যদি আপনি কাজটাকে ভালোবাসেন, তাহলে নিশ্চয়ই কাজের সময় ছাড়াও আপনি এটা নিয়ে ভাববেন। আপনার মস্তিষ্ক এই ভাবনার সঙ্গে অভ্যস্ত। আর যদি পছন্দ না করেন, জোর করে এটা সম্ভব নয়।’

৭. ঝুঁকি নিন


ঝুঁকি নেওয়ার কথা সম্ভবত তাঁর মুখেই সবচেয়ে ভালো মানায়! বারবার ঘুরেছে তাঁর জীবনের মোড়। জিপ টু বিক্রি করে তিনি এক্স ডটকম শুরু করেছেন, পেপ্যালের মতো একটা সফল প্রতিষ্ঠানে নিজের শেয়ারের অংশটা বিক্রি করে দিয়ে তিনি স্পেসএক্সের পেছনে লগ্নি করেছেন। ইলন বলেন, ‘কোনো কিছু করা দরকার মনে হলে প্রতিকূল পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হলেও আপনি সেটা করবেন।’ হ্যাঁ, পুরো ব্যাপারটিই ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। তবে জীবনে কিছু পেতে হলে ঝুঁকি তো নিতেই হবে!

৮. ‘হোমওয়ার্ক’ জরুরি


বিচিত্র সব খাতে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন ইলন মাস্ক। বিখ্যাত সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। কিন্তু তাঁর এই সাফল্যের রহস্যটা কী? রহস্য হলো, প্রস্তুতি না নিয়ে তিনি মাঠে নামেন না। তিনি যখন মহাকাশ ও অ্যারোনটিকসের দুনিয়ায় পা রাখলেন, অনেক শিল্পপতি ধরে নিয়েছিলেন, শখের বশেই হয়তো এই খাতে টাকাগুলো খরচ করছেন তিনি। কদিন পর নিশ্চয়ই ব্যর্থ হবেন। ভুল। নিজের লক্ষ্য ঠিক না করে ইলন পা বাড়াননি।

৯. মরিয়া হয়ে লড়াই করুন


আপনার কাছে ১০০ টাকা আছে, আপনি আজকের দিনের খাবার কিনতে পারবেন। কিন্তু তাই বলে আপনার কি বসে থাকাটা উচিত? ইলন মাস্ক সেটা একেবারেই মনে করেন না। অনেক কিছু থাকতেই পারে হাতে, হতে পারে কাজ করার খুব বেশি তাড়া নেই। তবে তাই বলে ধীরে-সুস্থে কাজ করা থেকে বিরত থাকুন আর মরিয়া হয়ে কাজ করুন। লড়াই করুন নিজের সঙ্গে! নিজের সেরাটা বের করে আনুন।

১০. পড়তে হবে


বিখ্যাত মানুষেরা সব সময়ই পড়ার ওপর জোর দেন। ইলন মাস্কও ব্যতিক্রম নন। ইলনের বয়স যখন নয় বছর, তখন তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পুরোটা পড়ে ফেলেছিলেন! সে সময় বিজ্ঞান কল্পকাহিনি পড়ে গড়ে ১০ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতেন। আজ সেই মানুষটির হাত ধরেই মঙ্গলে বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছে মানুষ। ভার্জ ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমার ছোট্ট লাইব্রেরিতে মহাকাশ-সম্পর্কিত যত বই আছে, সব আমি পড়েছি।’

গ্রন্থনা: প্রথম আলো - ১৪ এপ্রিল ২০১৮,, সূত্র: এন্ট্রাপ্রেনার ডটকম

Monday, March 5, 2018

ওয়ারেন বাফেটের সাফল্যের ১০ সূত্র

ওয়ারেন বাফেট একজন মার্কিন ব্যবসায়ী। বিনিয়োগের কলাকৌশল তিনি খুব ভালো জানেন। সাত বছর বয়স থেকেই ব্যবসার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। ছোটবেলায় চুইংগাম, কোকাকোলার বোতল, এমনকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ম্যাগাজিনও বিক্রি করেছেন। আর আজ? মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস ২০১৭ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষদের যে তালিকা তৈরি করে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, ওয়ারেন বাফেটের অবস্থান দ্বিতীয়। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিজনেস স্কুলের এই সাবেক ছাত্র সব সময় শিক্ষার্থী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর দেওয়া পরামর্শগুলো থেকে বাছাই করা ১০টি আজ তুলে ধরা হলো
১. খারাপ সময়ে ধৈর্য ধরুন
ওয়ারেন বাফেট সব সময় খারাপ সময়ে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। নিজের জীবন থেকেই নিশ্চয় এই শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তিনি। জীবনে বহুবার অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। ১৯৯৩ সালে প্রায় ৪৩ কোটি মার্কিন ডলার দিয়ে তিনি ডেক্সটার শ্যুজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে সেই কোম্পানি থেকে ৩৫০ কোটি ডলারের লোকসান হলেও ওয়ারেন বাফেট ধৈর্য হারাননি। ওয়ারেন বলেন, ‘সফলতার দুটি সূত্র। প্রথম সূত্র: কখনো হার মানা যাবে না। দ্বিতীয় সূত্র: প্রথম সূত্রটা কখনো ভোলা যাবে না।’
২. লক্ষ্য ঠিক রাখুন
ওয়ারেন বাফেট মনে করেন, যা করবেন তা পুরো মনোযোগ দিয়ে করা উচিত। ব্যবসার রোমাঞ্চে বুঁদ হয়ে আপনার ব্যবসায়িক বুদ্ধি হারালে চলবে না। সজাগ থাকতে হবে সব সময়। তিনি বলেন, ‘এমন ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন না, যা আপনি বোঝেন না।’ আপনার লক্ষ্য, আপনার মনোযোগ যেখানে একীভূত হবে, আপনি সেই দিকটিকেই ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিন।
৩. নিজের ওপর বিনিয়োগ করুন
ব্যক্তিগত দক্ষতার ওপর নির্ভর করছে আপনার সাফল্য। তাই ওয়ারেন বাফেট বলেন, ‘প্রথমত নিজের দক্ষতার ওপর বিনিয়োগ করুন। আপনার দক্ষতা যত বাড়বে, আপনার ব্যবসাও তত সৃজনশীল হবে।’ নিজেকে সময় দেওয়া যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, এ কথা তিনি সব সময় বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘মাঝেমধ্যেই আমি চুপচাপ বসে ভাবি। অনেকে বলতে পারেন এটা নিরর্থক। কিন্তু ব্যবসা ও বিনিয়োগের সমস্যা নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগে।’
৪. সঠিক সঙ্গ বেছে নিন
‘এমন মানুষদের সঙ্গে সময় কাটান, যাঁরা আপনার চেয়ে দক্ষ। আপনার সহযোগীদের ব্যবহার যেন আপনার চেয়ে ভালো হয় এবং তা যেন আপনাকে প্রভাবিত করে।’ ব্যবসার ক্ষেত্রে এই হলো ওয়ারেন বাফেটের মূলমন্ত্র। তিনি মনে করেন, মানুষের সততা খুব বড় গুণ। সবার মধ্যে এই গুণ প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। অতএব, সেই মানুষগুলোকেই আপনার আশপাশে রাখুন, যাঁরা ব্যবসার ক্ষেত্রে সৎ। যাঁদের আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। ওয়ারেন বাফেট দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের সঙ্গেই ব্যবসা করেছেন, যাঁদের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া ভালো।
৫. অনেক পড়তে হবে
পড়ুয়া হিসেবে এই ধনকুবের ব্যবসায়ীর বেশ সুনাম আছে। অবসর সময়ের ৮০ ভাগ তিনি বই পড়ার পেছনে ব্যয় করেন। বিজনেস অ্যাডভেঞ্চার্স, দ্য এসেস অব ওয়ারেন বাফেট এবং দ্য ইন্টেলিজেন্ট ইনভেস্টর—তরুণ উদ্যোক্তাদের তিনি এই বইগুলো পড়ার পরামর্শ দেন। এইচবিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এখনো দিনের পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা তিনি বই পড়ার পেছনে ব্যয় করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন অন্তত ৫০০ পৃষ্ঠা পড়ো। জ্ঞান হলো “চক্রবৃদ্ধি সুদ”-এর মতো। যত পড়বে, তত বাড়বে।’
৬. সমাজের জন্য কাজ করুন
সমাজ থেকে আপনি যেমন পাচ্ছেন, তেমনি সমাজের জন্য কাজ করাও আপনার দায়িত্ব। ওয়ারেন বাফেট বলেন, ‘বহু বছর আগে একজন একটা গাছ লাগিয়েছিল বলেই আজ একজন সেই গাছের ছায়া পাচ্ছে।’ অতএব আপনার পূর্বসূরির অবদান ভুলে গেলে চলবে না। আপনি যদি ১ শতাংশ সৌভাগ্যবান মানুষের মধ্যে পড়েন, বাকি ৯৯ ভাগ মানুষের জন্য কিছু করা আপনার দায়িত্ব।
৭. অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবুন
ব্যবসার ক্ষেত্রে অতীত ও ভবিষ্যৎ—দুটোকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মানেন ওয়ারেন বাফেট। তিনি মনে করেন, ভবিষ্যৎটা পরিষ্কার দেখতে না পারলেও ব্যবসার ক্ষেত্রে আমরা তো আমাদের অতীতটা স্পষ্ট দেখতে পাই। সেটাই আমাদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। আবার তিনি এ-ও বলেন, ‘টাকা উপার্জনের এই খেলায় যদি অতীত ইতিহাসই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতো, তবে লাইব্রেরিয়ানরাই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষ হতেন।’
৮. আপনার ‘নায়ক’ কে?
আপনি কাকে অনুসরণ করছেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কার মতো হতে চান? খুব ভেবে এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক করুন। ওয়ারেন বাফেট বলেন, ‘আমাকে বলো, তোমার চোখে “নায়ক” কে। আমি বলে দেব, তোমার ভবিষ্যৎ কী।’ অর্থাৎ আপনি কাকে আদর্শ বলে মানেন, সেটাই নির্ধারণ করবে আপনার ভবিষ্যৎ।
৯. বিশ্বাস থাকতে হবে
‘আমার বাবা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। আমিও বিশ্বাস করি নিজেকে।’ দ্য গ্রেট মাইন্ডস অব ইনভেস্টিং বইয়ের ভূমিকায় এভাবেই লিখেছেন ওয়ারেন বাফেট। তাঁর দাবি, সব সময় তাঁর মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল। বিফল হওয়ার কথা তিনি কখনো ভাবেননি। সফল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে যা ভালোবাসেন, তা-ই করেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘কত টাকা আয় হচ্ছে বা কত লাভ হচ্ছে, এই হিসাবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের ওপর বিশ্বাসটা অটুট আছে কি না।’
১০. ভুল থেকে শিখুন
ওয়ারেন বাফেট যে জীবনে শতভাগ সাফল্য পেয়েছেন, তা নয়। তিনি ভুল করেছেন। এমনকি ব্যবসায়িক জীবনে তিনি বড় বড় ভুলও করেছেন। তবে ভুল থেকে তিনি শিখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবনের ভুলগুলো মনে রেখে তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দেন ওয়ারেন বাফেট। তিনি মনে করেন, ভুলগুলোর কথা নিজের সন্তানদেরও জানানো উচিত। যেন তারা একই ভুল না করে।

Wednesday, June 14, 2017

হেলেন মিরেন মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখো- হেলেন মিরেন: অভিনয়শিল্পী, যুক্তরাজ্যে

অনুবাদ: প্রথম আলো

বয়স সত্তর পেরিয়েছে। অথচ এখনো কী দারুণ তাঁর রসবোধ! যুক্তরাজ্যের অভিনয়শিল্পী হেলেন মিরেন। দ্য কুইন ছবিতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের চরিত্রে অভিনয় করে অস্কারসহ একাধিক পুরস্কার বগলদাবা করেছিলেন। কমেডি থেকে শুরু করে ধুন্ধুমার অ্যাকশন—সব ধরনের ছবিতেই তিনি সপ্রতিভ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের টুলেইন ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন বক্তৃতায় হেলেন প্রাণ খুলে হেসেছেন, হাসিয়েছেন শ্রোতাদের।

শিক্ষার্থীরা, অবশেষে তোমরা পেরেছ! ক্লাস, প্রবন্ধ, আলোচনা, লেকচার, কম্পিউটারের সঙ্গে একেকটা বিনিদ্র রাত...সব পেরিয়ে তোমরা আজকের দিনে পৌঁছেছ। সব শেষে আর একটা মাত্র মানুষের কথা তোমাদের শুনতে হবে, সেই মানুষটা আমি। চেষ্টা করব আমার বক্তব্যটা যেন ‘লেকচার’ হয়ে না যায়। ভয় নেই, তোমাদের সামনে কথা বলব বলে ‘হোমওয়ার্ক’ করেই আমি এসেছি।
প্রতিটি চরিত্রে অভিনয়ের আগে আমি রীতিমতো গবেষণা করি। চরিত্রটি ভালোমতো বুঝে নিই। রেড ছবিতে সিক্রেট এজেন্টের চরিত্রের জন্য যেমন গুলি চালানো শিখেছিলাম। রানির চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শিখেছি, কীভাবে তিনি তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। আর টিচিং মিসেস টিঙ্গেল ছবিতে একজন বাজে শিক্ষকের চরিত্র রপ্ত করার জন্য গিয়েছিলাম এলএসইউতে কয়েকজন অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরাই সব শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
তা আজকের দিনের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিলাম? গবেষণা করে দেখলাম, একজন সমাবর্তন বক্তার কাছ থেকে শ্রোতারা আসলে কী শুনতে চায়। হাজারো পরামর্শ পাওয়া গেল, তবে মূল কথা মাত্র তিনটি।
প্রথমত, বক্তব্য ছোট রাখা। আধঘণ্টার লম্বা বক্তৃতা কেউ শুনতে চায় না। অতএব আমি বরং এখানেই শেষ করি, খাবার টেবিলে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে...(হাসি)
দ্বিতীয়ত, তোমার জীবনের গল্পটা এমনভাবে বলবে, যেন শ্রোতারা নিজের সঙ্গে মিল খুঁজে পায়। দুর্ভাগ্যবশত আজকের সমাবর্তন বক্তার সঙ্গে শুধু সে-ই নিজের মিল খুঁজে পাবে—যে শেক্সপিয়ারের গল্পের নায়িকা হতে চেয়েছিল—অথচ তাঁকে কিনা ১০টি চলচ্চিত্রে নিরাভরণ দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়েছে। তোমাদের বাবাদের মধ্যে কেউ পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে গুগলে আমার নাম লিখে ‘সার্চ’ করা শুরু করেন কি না, সেটা পরীক্ষা করার জন্যই এ কথা বললাম! বাবারা, থামুন।
তৃতীয়ত, সমাবর্তন বক্তার এমন একটা কথা বলা উচিত, যাতে শ্রোতারা তাঁর কথাটা অন্তত ৪০ বছর মনে রাখে। অনেক ভেবেচিন্তে এমন একটা কথা আমি খুঁজে পেয়েছি। আশা করি ২০৫৭ সাল পর্যন্ত এটা তোমাদের মনে থাকবে। কথাটা হলো—ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার কিংবা ওভাল অফিস, যেখানেই তুমি থাকো না কেন, রাত তিনটার সময় টুইট করাটা কোনো কাজের কথা না! (মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইট নিয়ে রসিকতা করে এ কথা বলেন হেলেন। বি. স.)
রাত তিনটা প্রসঙ্গে মনে পড়ল, নিউ অরলিন্সে ফিরে আসতে পেরে সত্যিই ভালো লাগছে। এখানে আমি কখনোই রাত তিনটার আগে ঘুমাতে পারিনি। গত কয়েক দিন এই ক্যাম্পাসের আনাচ-কানাচে ঘুরে তোমাদের জন্য একটা প্রশ্নই আমার মাথায় এসেছে—কোন দুঃখে তোমারা স্নাতক সম্পন্ন করছ? এত সুন্দর একটা জায়গা ফেলে বাইরে গিয়ে চাকরিবাকরি খোঁজার কী দরকার আমি বুঝি না! এখনো দেরি হয়ে যায়নি। ডিনকে বলো, তোমার ডিগ্রিটা রেখে দিতে, আর নিজের ডর্মে ফিরে যাও!
জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে আমি যা শিখেছি, সেসবের মধ্য থেকে কিছু কথা আমি তোমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেব। তোমরা একে বলতে পারো, সুখী জীবনের জন্য হেলেনের পাঁচ পরামর্শ।
প্রথম পরামর্শ: বিয়ে করার জন্য ব্যস্ত হয়ো না। জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এসে আমি টেইলরকে বিয়ে করেছি এবং এর সুফল পাচ্ছি। সব সময় তোমরা তোমাদের জীবনসঙ্গীকে তাঁর জীবনের লক্ষ্যটা পূরণ করতে সাহায্য কোরো।
দ্বিতীয় পরামর্শ: মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখো। অনেক অনেক দিন আগে আমার এক অভিনেত্রী বন্ধু খুব সহজ কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমাকে শিখিয়েছিল। আমার বন্ধুটি ধূমপান করত। আমরা একসঙ্গে ট্যাক্সিতে করে শুটিংয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে ধূমপান করার ব্যাপারে সেই সময় কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তো আমার বন্ধু একটা সিগারেট ধরাল এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গাড়ির চালককেও একটা সিগারেট সাধল। খুব সাধারণ একটা কাজ। কিন্তু ভেবে দেখ। সে কিন্তু গাড়ির চালককে ‘গাড়িচালক’ ভাবেনি, ‘মানুষ’ ভেবেছে। আজকের দিনে এ কাজ করলে হয়তো ‘হত্যাপ্রচেষ্টার’ অভিযোগে ওর জেল হয়ে যেত! কিন্তু এই শিক্ষাটার জন্য আমি আমার বন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞ। ঘটনাটা আমি কখনো ভুলব না। অতএব মনে রাখবে—তোমার ওপর কারও আধিপত্য থাক বা না থাক, সমপরিমাণ সম্মান ও বিনয় প্রতিটি মানুষের প্রাপ্য।
দ্বিতীয় পরামর্শটির সঙ্গে আরেকটি কথা যোগ করতে চাই। তুমি যে জেন্ডারেরই হও না কেন, নারীবাদী হও। বহু দেশ ও সংস্কৃতির মানুষ আমি দেখেছি। সুইডেন থেকে উগান্ডা, সিঙ্গাপুর থেকে মালি—সব জায়গার ক্ষেত্রেই একটি কথা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত—নারী যদি তাঁর প্রাপ্য সম্মান বুঝে পান, তাহলে পুরো জাতিই তার সুফল ভোগ করে।
তৃতীয় পরামর্শ: তুমি দেখতে কেমন, তার ওপর নির্ভর করে কেউ যদি তোমাকে বিচার করে, তাকে পাত্তা দিয়ো না। বিশেষ করে সে যদি মনিটরের পেছনে লুকিয়ে থাকা কোনো চরিত্র হয়। আর তুমি নিজেই যদি একজন মনিটরের পেছনে মুখ লুকিয়ে রাখা ইন্টারনেটে আসক্ত মানুষ হও—বন্ধ করো! স্রেফ বন্ধ করো। বাইরে গিয়ে অন্তত একটা কাজের কাজ করো।
চতুর্থ পরামর্শ: ভয়কে ভয় পেয়ো না। এটা ঠিক, কখনো কখনো ভয় পাওয়াটাই উচিত। অল্প পানির একটা পুলে লাফ দেওয়ার আগে ভয় পাওয়াই শ্রেয়। এসব ক্ষেত্রে বেশি করে ভয় পাও; এত বেশি যে ভয়ে যেন কাজটা তুমি না-ই করো। কিন্তু ‘আমি কি পারব? আমি কি যথেষ্ট বুদ্ধিমান? আমি হেরে যাব না তো?’—এইসব ভয়ের দিকে সোজাসুজি এগিয়ে যাও। একবার ভয়টা উতরে গেলেই চিরতরে সেটিকে লাথি মেরে উড়িয়ে দাও।
এবার আসি ‘হেলেনের সুখী হওয়ার পরামর্শ’ নম্বর পাঁচে। জীবনটাকে অতি জটিল কোরো না। কী করব, আর কী করব না—খুব স্বাভাবিক কিছু নিয়ম মেনে চললেই পথটা সহজ।
কাজে গড়িমসি কোরো না।
তোমার রসবোধ হারিয়ো না।
তোমাকে যারা উত্ত্যক্ত করে, তাদের মুখোমুখি দাঁড়াও।
ভালোবাসো।
ভালোবাসা আর যৌনতাকে গুলিয়ে ফেলো না। কেননা ভালোবাসা সাধারণত দুই মিনিটের বেশি টেকে!
এমন আরও অনেক ‘করো’ এবং ‘কোরো না’-এর কথা আমার বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি আসলে আজ সকালে শেষ মুহূর্তে এ তালিকাটা তৈরি করেছি।
আর হ্যাঁ, আরেকটি কথা—প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার তোমার মা-বাবাকে ফোন কোরো। ফোন করে বোলো, তুমি তাঁদের ভালোবাসো। টাকা চাওয়ার প্রসঙ্গটা না হয় এরপর আসুক!
সত্তরের দশকের শুরুর দিকে, তারুণ্যের উজ্জ্বল ও বিভ্রান্তিকর সময়টাতে আমি বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। মায়া সভ্যতার বিদ্যা থেকে আমি প্রচণ্ড অনুপ্রেরণাদায়ক একটি কথা শিখেছি। কথাটি আমি আমার বাঁ হাতে ট্যাটু করে রেখেছি।
খুব সহজ একটি প্রবাদ—‘ইনলাকেশ’।
এর অর্থ হলো, ‘তুমিই আমি। আমিই তুমি। আমরা এক।’
আমি যদি তুমি হই, তাহলে তোমার প্রতি আমার কিছু দায়িত্ব আছে। আবার তুমি যদি আমি হও, তাহলে আমার প্রতিও তোমার কিছু দায়িত্ব আছে। ‘এখানে আমরা সবাই এক’—এ কথাটাই মায়ানরা আরও সুন্দর ভাষায় বলতে চেয়েছেন।
হ্যাঁ, এই পৃথিবীতে আমরা সবাই একসঙ্গে আছি, কথাটি মনে রেখো। যেন খ্যাপাটে পৃথিবীটাকে তোমরা পথ দেখাতে পারো। (সংক্ষেপিত)
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ

সূত্র: টাইম

Sunday, June 5, 2016

ভেতরের স্বপ্ন, শক্তি, আলো কখনো নেভে না

ফেসবুকের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গ। প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড অব ডিরেক্টরদের মধ্যে একমাত্র নারী সদস্যও তিনি। ২০১২ সালে টাইম সাময়িকীর করা বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী মানুষের তালিকায় ছিল তাঁর নাম। গত ১৪ মে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের সমাবর্তনে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।
শেরিল স্যান্ডবার্গসমাবর্তন অনুষ্ঠানে সাধারণত তরুণ আর প্রবীণের একটা চমৎকার সমন্বয় থাকতে হয়। তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে তোমরা তো আছই। প্রবীণের ভূমিকাটা আমার পালন করার কথা। আমি তোমাদের বলব জীবন থেকে আমি কী শিখেছি, তোমরা বাতাসে সমাবর্তনের টুপি ওড়াবে, পরিবারের সঙ্গে হাজারো ছবি তুলবে, ছবিগুলো ইনস্টাগ্রামে আপলোড করবে, হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যাবে—তাই তো?
আজকে না হয় একটু ব্যতিক্রম হোক। হ্যাঁ, টুপি ওড়ানো কিংবা ছবি তোলার ব্যাপারটা একই রকম থাকবে। কিন্তু জীবন থেকে আমি কী শিখেছি, সেটা আজ তোমাদের বলব না। বরং বলব, মৃত্যু আমাকে কী শিখিয়েছে।
কখনো জনসমক্ষে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলিনি। ব্যাপারটা কঠিন। বলার সময় আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব যেন বার্কলের এই সুন্দর সমাবর্তন গাউনে আমাকে চোখ মুছতে না হয়।
ঠিক ১ বছর ১৩ দিন আগে আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি। ডেভ। ওর মৃত্যুটা ছিল আচমকা, অপ্রত্যাশিত। আমরা মেক্সিকোতে এক বন্ধুর ৫০তম জন্মদিন উদ্যাপন করতে গিয়েছিলাম। ডেভ যখন জিমে ব্যায়াম করতে গেল, আমি তখন একটু চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এর কিছুক্ষণ পর আমাকে ডেভের নিথর দেহটা জিমের মেঝেতে আবিষ্কার করতে হলো। বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়েদের বলতে হলো, তোমাদের বাবা আর নেই।
এরপর কয়েক মাস আমি গভীর বিষাদে ডুবে ছিলাম। আরও স্পষ্ট করে বললে, একটা শূন্যতা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। সে শূন্যতা এতই প্রকট যে আমার কোনো কিছু ভাবতে, এমনকি নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হতো। ডেভের মৃত্যু খুব স্পষ্টভাবেই আমাকে বদলে দিল। আমি দুঃখের গভীরতা আর হারানোর ব্যথা বুঝলাম। একই সঙ্গে আমি এ-ও বুঝলাম, জীবন যখন তোমাকে নিচের দিকে টানতে থাকে, সে অবস্থায়ও সব ভেঙেচুরে উঠে আসা যায়, বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া যায়। আমি শিখলাম, শূন্যতাকেও আনন্দময় আর অর্থবহ করে তোলা যায়।
এই আশায় তোমাদের এসব কথা বলছি, যেন এই শিক্ষাটা তোমরা আজই পাও। যেটা আমি মৃত্যু থেকে পেয়েছিলাম। আমাদের ভেতর স্বপ্ন, শক্তি আর আলো—নিবু নিবু করেও কখনো নিভে যায় না।
ছোট ছোট না পাওয়া তোমাদের কাতর করে। তুমি হয়তো ‘এ’ আশা করেছিলে, কিন্তু ‘এ-’ পেয়েছ। তুমি ফেসবুকে ইন্টার্নশিপের জন্য আবেদন করেছ, কিন্তু পেয়েছ গুগলে। তুমি কারও প্রেমে পড়েছ, কিন্তু সে তোমাকে ছেড়ে গেছে।
নিশ্চিত থাকো, এর চেয়েও দুঃখের মুহূর্ত তোমার সামনে আসবে। পছন্দসই একটা চাকরি হয়তো তুমি পাবে না। একটা দুর্ঘটনা কিংবা অসুস্থতা হয়তো মুহূর্তে তোমার জীবন বদলে দেবে। একটা ভাঙা সম্পর্ক, হয়তো আর কখনো জোড়া লাগবে না।
সহজ দিনগুলো সহজেই পেরিয়ে যাবে। আমি বলছি কঠিন সময়গুলোর কথা। যে সময় তোমার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। কঠিন সময়ই নির্ধারণ করবে, তুমি কে? শুধু তোমার অর্জনই তোমার পরিচয় নয়। বরং তুমি কীভাবে টিকে আছ, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনোবিদ বন্ধু অ্যাডাম গ্র্যান্ট একবার বলছিল, এর চেয়েও খারাপ কী হতে পারত, সেটা ভেবে আমার সান্ত্বনা পাওয়া উচিত। আমি বলেছিলাম, ‘কী বলছ! আমার স্বামী হঠাৎ “কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়া”য় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে?’ সে বলল, ‘ধরো এমনও তো হতে পারত, তোমার স্বামীর যখন কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়া হলো, তখন সে গাড়ি চালাচ্ছিল। আর পেছনের সিটে বসে ছিল তোমার ছেলেমেয়েরা!’ ওর কথা শোনামাত্র আমার ভেতরটা কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। তাই তো, জীবন অন্তত আমার কাছ থেকে আমার ছেলেমেয়েদের কেড়ে নেয়নি!
কৃতজ্ঞতাবোধ হলো স্থিরতার চাবি। জীবনের আশীর্বাদগুলোর মূল্যায়ন করলেই এমন আশীর্বাদ তুমি আরও পাবে। এ বছরের শুরুতে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দিনের সেরা তিনটা মুহূর্ত লিখে রাখব। এই ছোট্ট একটা অভ্যাস আমার জীবন বদলে দিয়েছে। কারণ প্রতিদিন যা-ই ঘটুক না কেন, আমি আনন্দময় কিছু ভাবতে ভাবতে ঘুমাতে যাই। অন্তত চেষ্টা করি। আজ থেকেই তুমিও শুরু করতে পারো।

Saturday, November 7, 2015

একসঙ্গে একাধিক কাজ নয়: অ্যারিয়ানা হাফিংটন

গ্রিক-আমেরিকান লেখক ও কলামিস্ট অ্যারিয়ানা হাফিংটনের জন্ম ১৯৫০ সালের ১৫ জুলাই। অ্যারিয়ানা অনলাইন নিউজপোর্টাল হাফিংটন পোস্ট-এর সম্পাদক। তিনি ২০১৩ সালে স্মিথ কলেজের সমাবর্তনে এই বক্তব্য দেন।
অ্যারিয়ানা হাফিংটনঅভিনন্দন তোমাদের সবাইকে। সমাবর্তন বক্তাদের কাছ থেকে সবাই ‘সফল হওয়ার সহজ উপায়’-জাতীয় কিছু উপদেশ আশা করে। কিন্তু তার বদলে আমি চাইব সাফল্যের সম্পূর্ণ ধারণাটিকেই তোমরা ভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করো। আজকের পৃথিবীতে এটিই প্রয়োজন। শুধু শীর্ষ স্থান দখল করে বসে থাকলে হবে না, যেখানে আছো, সে স্থানটিকে বদলে দাও, পৃথিবীকে বদলে দাও। 
আমাদের সমাজে সাফল্য বলতে প্রধানত দুটো জিনিসকেই বোঝানো হয়: অর্থ ও ক্ষমতা। এমনকি সাফল্য, অর্থ ও ক্ষমতা—এই তিনটি শব্দ আজকাল প্রায় সমার্থক হয়ে পড়েছে। কিন্তু অর্থ ও ক্ষমতার বাইরেও আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। আমরা এমন সাফল্য চাইব, যার মধ্যে থাকবে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, জ্ঞান ও বিবেক, জীবনের প্রতি কৌতূহল ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা। শুধু অর্থ আর ক্ষমতা দুই পায়ের একটি টুলের মতো, এর ওপর ক্ষণিকের জন্য ভারসাম্য বজায় রাখা যায় কিন্তু একসময় তুমি ঠিকই উল্টে পড়বে। অসংখ্য সফল মানুষ এভাবেই উল্টে পড়েছেন, এখনো পড়ছেন। সাফল্যকে আমরা যেভাবে এত দিন ব্যাখ্যা করে এসেছি, তা আর গ্রহণযোগ্য নয়। সময় এসেছে জীবনকে নতুন চোখে দেখার। 
সফল হওয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের যতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তার পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলছে। নারীদের জন্য এই মূল্য আরও বেশি। যেসব নারী কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকেন, তাঁদের হূৎপিণ্ডের সমস্যায় ভোগার আশঙ্কা শতকরা ৪০ ভাগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এ শতাব্দীর কর্মজীবীরা, মানে তোমাদের মতো এত চাপ অতীতের কোনো প্রজন্মই মোকাবিলা করেনি। এই মুহূর্তে আমেরিকার অফিসগুলো কাজের চাপে বিধ্বস্ত, নির্ঘুম রাত কাটানো মানুষদের দিয়ে চলছে। ২০০৭ সালে আমার অবস্থাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। নিদ্রাহীন, পরিশ্রান্ত শরীরে আমি ডেস্কের ওপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার মাথায় আঘাত লেগেছিল, গালের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, ডান চোখের ওপর চারটা সেলাই দিতে হয়েছিল। নিদ্রাহীনতা যে শুধু শরীরের ক্ষতি করে তা নয়, এর ফলে তোমার সৃজনশীলতা, কর্মদক্ষতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা—সবকিছুতেই প্রভাব পড়ে। 
নিউইয়র্কে হাফিংটন পোস্ট-এর অফিসে দুটো রুম আছে শুধু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। প্রথম প্রথম আমাদের সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকৌশলীদের কেউই রুমগুলো ব্যবহার করতে চাইতেন না। তাঁরা ভাবতেন অন্যরা মনে করবেন কাজ ফাঁকি দিয়ে অফিসে এসে ঘুমানো হচ্ছে! অতঃপর আমরা অফিসের পরিবেশটা এমনভাবে বদলে ফেলেছি, যাতে বিশ্রাম নেওয়া নয়, বরং বিধ্বস্ত শরীরে হেঁটে বেড়ানোকেই বাঁকা চোখে দেখা হয়। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে এখন রুম দুটো খালি পাওয়াই মুশকিল! 
সাফল্যের সংজ্ঞায় সুস্থতাকে যোগ করার অর্থ হলো, জীবনে আর্থিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মানুষ হিসেবে আমাদের মানবিক চাহিদাগুলোর দিকেও নজর দেওয়া। আমার মা এই কাজটি খুব ভালো পারতেন। আমার বয়স যখন ১২, একদিন অত্যন্ত সফল এক ব্যবসায়ী আমাদের বাসায় ডিনারে এসেছিলেন। তাঁকে ভারি ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল। যখন আমরা খেতে বসলাম তখন তিনি ক্রমাগত বলতে থাকলেন তাঁর ব্যবসায় কত লাভ করছে, কী দারুণ চলছে সবকিছু। কিন্তু মা তাতে ভোলার পাত্রী ছিলেন না। তিনি সোজাসুজি বলেছিলেন, ‘আপনার ব্যবসা কত ভালো করছে তাতে কিছুই আসে-যায় না, যখন আপনি নিজেই ভালো নেই। আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আপনি নিজেই। আপনার স্বাস্থ্যের অ্যাকাউন্ট থেকে আপনি শুধু চেক তুলেই যাচ্ছেন। যদি শিগগিরই সেখানে কিছু জমা না করেন তবে দেউলিয়া হতে আর বেশি দিন বাকি নেই।’ কিছুদিন পরই সেই ব্যবসায়ীকে একটি বড় অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। 
সুস্থতার প্রতি মনোযোগ দিলে আরও একটি চমৎকার ব্যাপার ঘটবে। ভেবে দেখো তো সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিছুই করা হয়ে উঠছে না—এমন চিন্তা কখনো মাথায় আসে কি না? সব সময়ই আসে, তাই না? যখনই ঘড়ির দিকে তাকাও, দেখবে যা ভেবেছিলে তার চেয়ে বেশি বাজে। সমস্যা হচ্ছে, যতক্ষণ আমরা দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অর্থ আর ক্ষমতার পেছনে ছুটতে থাকব, জীবনের অন্য দিকগুলো দেখেও দেখা হবে না। আমরা কৌতূহলী হতে ভুলে যাব। আমার মাকে দেখেছি সারাক্ষণ কৌতূহলী চোখে জীবনকে উপভোগ করছেন, তিনি রান্নাঘরে বাসন ধোয়ার সময়ই হোক আর সাগরপারে শঙ্খচিলদের খাওয়ানোর সময়ই হোক। জীবনের ছোট ছোট জিনিস থেকে শুরু করে এই মহাবিশ্বের নানা রহস্য—সবকিছুই তাঁকে সমানভাবে মোহিত করে রাখত। আমি যখন কোনো ব্যাপার নিয়ে অভিযোগ করতাম বা মন খারাপ করে থাকতাম, মা বারবার আমাকে একটি উপদেশ দিতেন; বলতেন, ‘মামণি, চ্যানেলটা বদলে দাও। রিমোট তো তোমার নিজের হাতেই। ভয়ের ছবি আবার দেখার কী দরকার।’
পৃথিবীজুড়ে, রাজনীতি, ব্যবসা, মিডিয়া—সব ক্ষেত্রেই আমরা অনেক বুদ্ধিমান নেতৃত্বের দেখা পাই, যাঁরা কিছু জঘন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের আইকিউ বা বুদ্ধিমত্তার কোনো ঘাটতি নেই, বরং তাঁদের জ্ঞান ও বিবেকের অভাব রয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, আজকাল আমরা সবাই আমাদের অন্তর্নিহিত সত্তার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় হারাতে বসেছি। আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে অগুনতি যন্ত্র, চোখ আটকে আছে একাধিক স্ক্রিনে, সামাজিক জীবন বন্দী হয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়—এত কিছুর মায়া ছাড়িয়ে নিজেদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন আজ সত্যি কঠিন। 
আবার ফিরে আসি মায়ের গল্পে। মারা যাওয়ার আগে শেষবার মা আমার সঙ্গে রাগ করেছিলেন, যখন আমি একই সঙ্গে ই-মেইল পড়ছিলাম আর আমার সন্তানদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। মা রেগে বলেছিলেন, ‘আমি একসঙ্গে একের বেশি কাজ করা দুই চোখে দেখতে পারি না।’ সত্যিই তো, সারা পৃথিবীর সবকিছুর সঙ্গে ভাসা ভাসাভাবে যুক্ত থাকতে গিয়ে আমরা সবচেয়ে আপনজনদের কাছ থেকে হারিয়ে যাই, এমনকি নিজের কাছ থেকেও। আমি বলছি না প্রযুক্তি থেকে নিজেদের একদম বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। কিন্তু নিয়মিত, প্রয়োজন অনুসারে আমাদের যান্ত্রিকতাকে সরিয়ে রেখে নিজেদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। শুধু তার লাগিয়ে আমাদের যন্ত্রগুলোকে রিচার্জ করলে হবে না, তার খুলে রেখে আমাদের নিজেদেরও মানসিকভাবে রিচার্জ করে নিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, সব মানুষের ভেতরই জ্ঞান ও শক্তির একটি পুঞ্জীভূত সাম্যাবস্থা বিরাজ করে। পৃথিবীর সব ধর্মই বলে যে ঈশ্বরের অবস্থান মানুষের হূদয়ে—সে ইসলাম, খ্রিষ্ট, বৌদ্ধ বা অন্য যে আদর্শের অনুসারীই হোক না কেন। আমরা অন্তরের সেই অন্তস্তল থেকে প্রায়ই দূরে সরে যাই, জীবন এমনই। কিন্তু যখন আমরা সেই সংযোগ পুনঃস্থাপন করতে পারি, তা জীবনকে আগাগোড়া বদলে দেয়। বাধা-বিপত্তি-হতাশা যা-ই আসুক না কেন, আমাদের বিশ্বাস ফিরে আসে। জীবনের মানে তখনই বোঝা যায়, যখন আমরা পেছন ফিরে তাকাই। সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতিগুলোও তখন অর্থবহ হয়ে ওঠে। তাই এটা মনে করাই ভালো যে যা ঘটছে, আমাদের ভালোর জন্যই ঘটছে। 
আজ এই সুন্দর ক্যাম্পাস ছেড়ে যখন তোমরা নিজেদের স্বপ্ন সত্যি করার যাত্রা শুরু করছ, তখন তোমাদের কাছে আমার একটিই অনুরোধ, সমাজের চোখে যা সাফল্য, সেই মরীচিকার পেছনে ছুটো না। এই তথাকথিত সাফল্য লাভের ফর্মুলা কারও জন্যই কাজ করছে না। এমন সাফল্য নারীর জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়, পুরুষের জন্য নয়, এমনকি উত্তর মেরুর শ্বেতভালুকদের জন্যও এসব কোনো উপকারে আসবে না, এ আমি দিব্যি বলতে পারি! শুধু তাদেরই উপকারে আসবে, যারা ডায়াবেটিস, হূদরোগ, অনিদ্রা আর রক্তচাপের জন্য ওষুধ বানাচ্ছেন।
তাই অন্তঃসারশূন্য কোনো করপোরেট ব্যবস্থার বা রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েই আত্মতৃপ্তিতে ডুবে যেয়ো না। সমস্যার গভীরে প্রবেশ করো, সমাধানের পথ খুঁজে দেখো। জীবনের আসলে কিসের মূল্য আছে আর কী করলে সফল হওয়া যায়, সেই ধারণাগুলোকে বদলে দাও। মনে রেখো, কত টাকা উপার্জন করলে আর কত ওপরে উঠতে পারলে, এসব ব্যাপার তোমাকে অসংখ্যবার অসংখ্য মানুষ মনে করিয়ে দেবে, কিন্তু নিজের কাছে নিজে সৎ থাকলে কি না, নিজের যত্ন নিলে কি না, জীবনকে উপভোগ করতে পারলে কি না এসব কেউ তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে আসবে না। নিজের হূদয়ের সঙ্গে তোমার নিজের চেষ্টাতেই যুক্ত থাকতে হবে; যেখান থেকে সবকিছু সম্ভব হয়। আর সেখান থেকেই তুমি পারবে পৃথিবীকে বদলে দিতে, এমন পৃথিবী গড়তে, যেখানে নারী-পুরুষনির্বিশেষে আমরা সবাই ভালো থাকতে পারি, ভালোবাসতে পারি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার

কখনো একইভাবে দুবার হারবে না: চাক নরিস

চাক নরিস (জন্ম: মার্চ ১০, ১৯৪০) বিখ্যাত আমেরিকান মার্শাল আর্টিস্ট ও অভিনেতা। ২০০৮ সালে লিবার্টি ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে চাক নরিস যে বক্তৃতা দেন, এটি তার সংক্ষেপিত ভাষান্তর।
চাক নরিসতোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, আজকের সুন্দর সকালে আমাকে তোমাদের সামনে কিছু বলতে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। 
আমি স্বীকার করি, এই কাজটা আমি একদমই করতে পারি না। এটাই আমার প্রথম সমাবর্তন বক্তৃতা।
জীবনে সৃষ্টিকর্তা সব সময়ই আমাকে সাহায্য করে গেছেন, পথ দেখিয়েছেন। আমার জন্ম ওকলোহামাতে। বলতে বাধা নেই, আমার পরিবারে অনেক অভাব ছিল; কিন্তু আমার মা ছিলেন অসাধারণ একজন নারী। আর আমার বাবা ছিলেন একজন মদ্যপ, তিনি বলতে গেলে আমার জীবনে কোনো ভূমিকাই রাখেননি। 
ছোটবেলায় আমি অনেক লাজুক ও আত্মমুখী ছিলাম; খেলাধুলাও তেমন করতাম না। আমি কখনো স্কুলে আমার ক্লাসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে পারিনি। যখনই শিক্ষক আমাকে কিছু বলার জন্য ডাকতেন, আমি আমার নিজের সিটে বসে মাথা ঝাঁকাতাম। কারণ, আমি ভয় পেতাম, আমি কথা বললে সবাই হাসবে। যদিও আমার বসে থাকা দেখে অনেকে হাসত এবং এতে লজ্জায় আমার চেহারা লাল হয়ে যেত।
হাই স্কুল পাস করে আমি বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়ে কোরিয়া চলে গেলাম এবং সেখানেই মার্শাল আর্ট বিষয়টার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। ১৯৬১ সালে যখন আমি সেখান থেকে ফিরে আসি, আমার সঙ্গে ছিল তায়েকোয়ান্ডোর ব্ল্যাক বেল্ট ও জুডোর ব্রাউন বেল্ট। তখন আমেরিকার খুব বেশি লোক মার্শাল আর্ট সম্পর্কে জানত না। আমি একটি মার্শাল আর্ট ক্লাব খুললাম এবং সবাইকে আমন্ত্রণ জানালাম। আমি ভাবলাম, আমাকে নিশ্চয় আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সামনে কিছু বলতে হবে। আমি আধা পৃষ্ঠার একটি বক্তৃতা তৈরি করলাম এবং সাত দিন সেটা মুখস্থ করলাম। সেটা আমি এত ভালো মুখস্থ করেছিলাম যে উলটো দিক থেকেও তা বলতে পারতাম।
আমি ৫০০ জন আমন্ত্রিত অতিথির মাঝখানে হেঁটে গেলাম, আর বললাম, ‘শুভসন্ধ্যা। আমার নাম চাক নরিস এবং আমি আপনাদের এখানে অভিবাদন জানাচ্ছি’—এটাই ছিল শেষ বাক্য, যেটা আমার মনে আছে। এরপরের যে স্মৃতি আমার মনে আছে, সেটা হলো অতিথিদের মাঝখান থেকে চলে আসার এবং কিছু কায়দা দেখানোর স্মৃতি। আমি এখনো জানি না, সেদিন আমি অতিথিদের সামনে কী বলেছিলাম। আমি যে কাজটা করেছিলাম, সেটা ছিল ২১ বছর ধরে যে অবিশ্বাস নিজের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, সেটাকে ভেঙে ফেলা।
আমি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর লস অ্যাঞ্জেলসে প্রথম মার্শাল আর্ট স্কুল খুললাম। মার্শাল আর্টের মূল যে শিক্ষাটি আমি পেয়েছি সেটা হলো, একজন তখনই হারে, যখন সে পরাজয়ের অভিজ্ঞতাটি থেকে কোনো শিক্ষা পায় না। তাই আমি আমার ছাত্রদের শেখাই, তোমরা হারতে পারো, কিন্তু কখনো একইভাবে দুবার হারবে না।
আমার স্কুল ভালোই চলছিল, এ সময় একটি কোম্পানি এসে আমার স্কুলের স্বত্ব কিনে নিতে চাইল। তখন আমার তিনটি স্কুল ছিল। কোম্পানিটি আমাকে জানায়, তারা সারা দেশে ‘চাক নরিস মার্শাল আর্ট স্কুল’ খুলতে চায়। আমি ভাবলাম, ভালোই তো। আমি আমার স্কুলকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেব। এর দুই বছর পরে সেই কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে যায় এবং আমি আমার সব কটি স্কুল হারাই।
আমি কিন্তু থেমে যাইনি। নতুন করে কিকস্টার্ট নামে একটি ফাউন্ডেশন চালু করলাম। ১৫ বছর ধরে আমি হাজারো তরুণের মধ্যে মার্শাল আর্টের দর্শনকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছি। আমেরিকার লাখো মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের বাণিজ্যিক মার্শাল আর্ট স্কুলে পাঠাতে পারেন না। আমি ভেবেছি, কীভাবে তাঁদের সাহায্য করতে পারি। আমি ঠিক করলাম, প্রতি শহরের মিডল স্কুলগুলোতে বিনা মূল্যে আমি মার্শাল আর্ট শেখাব, যার ব্যয়ভার নেবে আমার ফাউন্ডেশন। 
এটা ছিল ১০ বছর আগের কথা। এর মধ্যে আমাদের স্কুল থেকে এক লাখ ৫০ হাজার তরুণ মার্শাল আর্ট শিক্ষা নিয়েছে। কিন্তু একজন ছেলের কথা আমি বিশেষ করে বলতে চাই, যে ছিল আমাদের জন্য সাফল্যের একটি বড় প্রেরণা। আমরা স্কুলে মূলত ষষ্ঠ,সপ্তম, অষ্টম মানের শিশুদের শিক্ষা দিই। কারণ, এ সময়েই শিশুরা সবচেয়ে দ্রুত শেখে। আমাদের লক্ষ্য থাকে, যাতে তারা এ সময়ে সঠিক পথ থেকে সরে না যায় এবং জীবনের লক্ষ্য ঠিক রাখে। কিন্তু আমাদের সেই ছেলেটি এই সময়ে একটি সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ছেলেটি ষষ্ঠ মানে পায় ‘ডি’ গ্রেড এবং তখন বাইরের দলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। কিন্তু মার্শাল আর্ট শুরু করার পরে তার চরিত্র পাল্টে যেতে থাকে এবং বাস্তবিকই সে ভালোর পথে আসে। সে তার অন্য দলের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে এবং তার পড়ালেখাতেও উন্নতি করতে থাকে। সপ্তম মানে তার গ্রেড আসে ‘সি’ এবং অষ্টম মানে এসে সে পায় ‘বি’ গ্রেড। মার্শাল আর্ট তার মনজগৎকে বদলে দেয় এবং ছেলেটি নবম থেকে ১২শ মান পর্যন্ত টানা ‘এ’ গ্রেড পেয়ে এমআইটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। 
মার্শাল আর্ট আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছে। আমি মনে করি, এটা আরও অনেক তরুণের জীবন গড়ে দিতে সক্ষম। সৃষ্টিকর্তা আমাকে সব সময় সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তোমরা তাঁর ওপর বিশ্বাস আনো আর পরিশ্রম করে যাও, জীবনের সবকিছু ভালোভাবেই এগোবে। 
তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। 
সূত্র: ওয়েবসাইট, ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: মনীষ দাশ

রাজকুমার হিরানি : জীবনে থামতে জানতে হয়

পিকে (২০১৪) ও থ্রি ইডিয়টস (২০০৯) ছবির জন্য আলোচিত রাজকুমার হিরানি। হিরানি পরিচালিত অন্য দুটি চলচ্চিত্র মুন্নাভাই এমবিবিএস (২০০৩) ও লাগে রাহো মুন্না ভাই (২০০৬)। তাঁর জন্ম ১৯৬২ সালের ২০ নভেম্বর ভারতের নাগপুরে। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেও তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন চলচ্চিত্রকে।
আপনার জীবনাদর্শ কী? জীবনে বহুবার আমি এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। কখনোই প্রকৃত উত্তর খুঁজে পাইনি। আমরা আসলে কেউই জানি না আমরা কেন এই ধরাধামে এসেছি। মানুষ বাঁচে কত দিন? বড়জোর ষাট, সত্তর কিংবা আশি বছর? প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর আপনি যদি মনে করেন জীবনটা খুবই সংক্ষিপ্ত, তাহলে দেখবেন, জীবনটাকে আপনি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা প্রায় সবাই মনে করি, আমাদের হাতে প্রচুর সময় রয়েছে, জীবনের আয়ু সংক্ষিপ্ত নয়।
তাই আমি মনে করি, আমাদের প্রতি মুহূর্তে মনে করা উচিত, এ পৃথিবীতে আমাদের সময় খুব, খুব সামান্য। আজ থেকে ৫০ অথবা ৭৫ বছর পর কেউ হয়তো আমাকে আর চিনবে না। তো এসব চিন্তা করে ঘুম নষ্ট করার দরকার কী! এসব নিয়ে আমি মোটেও মাথা ঘামাই না। আমাদের প্রয়োজন টাকা, আমাদের প্রয়োজন সম্পদ, কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, এসব অর্জনেরও একটা সীমা আছে। আমি মনে করি, মানুষের জীবনে সত্যিকার অর্থে দুটি সমস্যা আছে—এক. স্বাস্থ্য ও দুই. দারিদ্র্য।
আপনি দেখবেন, যারা জ্যোতিষীর কাছে যায়, তারা জানতে চায় তাদের টাকাপয়সা কিংবা সম্পদ হবে কি না, তাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে কি না ইত্যাদি। কারণ জীবনের শেষ বেলায় এক সকালে উঠে আপনার মনে হবে, আপনার দেখভাল করার মতো কেউ আছে কি না। আর তখনই আপনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে।
আমি মনে করি, আমি সব সময় ও রকমটাই ভাবি। এটা কিছুটা বংশগত ব্যাপারও বটে। আমি সৌভাগ্যবশত এমন এক পরিবারে জন্মেছি যে পরিবারটা খুব একটা ধনী ছিল না। তবে বাবা চিন্তা-চেতনায় ছিলেন যথেষ্ট আধুনিক।
একবার আমাকে খুব ভয় দেখানো হলো। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে গিয়ে জানলাম, শরীরের কোনো একটা অংশ ঠিকঠাকমতো কাজ করছে না। চিকিৎসক বললেন, পরিবারের কাছে ফিরে যান, আপনি খুব শিগগিরই জটিল রোগে আক্রান্ত হবেন। চাপের মধ্যে ভালো কাজ করা মানে অনেকটা সংগ্রাম করার মতো। আমি সব সময় চেষ্টা করি এই ‘মানসিক চাপ’ বিষয়টাকে পাত্তা না দিতে।
বিলিয়ার্ড খেলোয়াড় গীত সিতাই একবার আমাকে বলেছিলেন, তিনি একবার থাইল্যান্ডে ফাইনাল খেলা খেলছিলেন। তাঁর প্রতিপক্ষের নাম ছিল সম্ভবত ওয়াত্তানা। এই খেলোয়াড় প্রচুর পয়েন্ট নিয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা খেলায় হেরে গেলেন এবং তারপর একের পর এক হারতে লাগলেন। স্বাভাবিকভাবেই গীত তখন খুব অবাক হয়েছিলেন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ব্যাপার কী? উত্তরে ওয়াত্তানা বলেছিলেন, আমি মনে করি, আমি সেই খেলায় অবশ্যই জিততাম। কিন্তু আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিল পুরস্কারের টাকার দিকে। আমি ভাবছিলাম, পুরস্কারের টাকা পেলে আমার বাবার জন্য একটা বাড়ি কিনব। এই ভাবনা আমাকে কিছুটা বিভ্রান্ত করেছিল। আমি তখন কিছুটা নার্ভাস বোধ করছিলাম। কিছুতেই খেলায় মনঃসংযোগ করতে পারছিলাম না এবং যার ফলে আমার প্রতিপক্ষ খেলাটায় জিতেছিল।
গীতের এই গল্প থেকে আমি শিখেছিলাম, আপনি কী করছেন, তার লক্ষ্য ঠিক রাখা খুবই জরুরি।
আমি সম্প্রতি ক্রিস্টোফার নোলানের একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তিনি কোনো মুঠোফোন ব্যবহার করেন না। এমনকি তাঁর কোনো ই-মেইল আইডিও নেই। প্রতিদিন আপনি নাছোড় বান্দার মতো অন্তত ২০ হাজার মানুষের মনোযোগ চান। কিছু মানুষ এ বিষয়টিকে উপভোগ করতে পারে, তবে কিছু মানুষ মনে করে এটা এক ধরনের চিত্তবিনোদন। তো এ কথা বললাম এ জন্য যে আমাকে বিরক্ত করার কেউ নেই, না ফোন, না কোনো মানুষ। কিন্তু যখন আপনি একটু একটু করে পরিচিত হয়ে উঠবেন, তখন অনেক কিছুই আপনার পিছু লাগবে। জগতে চিত্তবিনোদনের অনেক উপাদান আছে। আপনাকে কর্মে সফল হতে হলে ওই সব থেকে অবশ্যই নিজেকে দূরে রাখতে হবে।
প্রত্যেকের বোঝা উচিত, ‘প্রয়োজন’ ও ‘লোভের’ মধ্যে পার্থক্য কী। আপনার জানা উচিত, ঠিক কোন জায়গাতে আপনাকে থামতে হবে এবং এটাও জানা উচিত, ‘আর নয়, বহুত হয়েছে’ কথাটা কখন বলতে হবে। অনিশ্চয়তা আপনাকে খতম করে দিচ্ছে? পৃথিবীর সবেচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তির দিকে তাকান, তিনিও বলবেন, ভয় লাগে, কখন সব শেষ হয়ে যায়! আপনি যদি এই অনিশ্চয়তার ভয় কাটাতে পারেন, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
অনেকেই আপনাকে খারাপ মানুষ মনে করতে পারে। কিন্তু আপনি নিজেকে কখনোই খারাপ মনে করেন না। এটা মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। এ বিষয়টি প্রথম মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল বোমান ইরানি, যখন আমরা একসঙ্গে মুন্না ভাই এমবিবিএস বানাচ্ছিলাম তখন। বিষয়টি নিয়ে বোমানের সঙ্গে অনেক বিতর্ক হয়েছে আমার। এরপর থেকে আমি যখন আমার ছবির কোনো চরিত্রের কথা ভাবি, তখন কখনোই সেই চরিত্রকে ‘ভিলেন’ হিসেবে ভাবি না। কারণ সে তাঁর জীবনে তো ‘হিরো’। নিজের জীবনে মানুষ কখনো নিজেকে ‘খলনায়ক’ হিসেবে দেখে না। সে কখনোই ভাবে না যে সে একজন খারাপ মানুষ।
সুতরাং এখন আপনি বুঝতেই পারছেন, আমরা আমাদের মাথার ভেতর আসলে গল্প তৈরি করি, ভিলেন বানাই।
কিছুদিন আগে মুম্বাই ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি বলেন, ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষার দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন আমাদের বাচ্চাদেরও হাতে পৌঁছে গেছে আইপ্যাড, আইফোন। এ যন্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে ভালো শিক্ষক।
থ্রি ইডিয়টস দেখার পর কত মানুষ আমার কাছে এসেছে, আমি তা বলে বোঝাতে পারব না। তারা বলেছে, তাদের মধ্যে কত গলদ আছে! আমি আপনাকে বলতে পারব না যে কত প্রকৌশলী আমার কাছে এসেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘আমরা ভুল পেশায় আছি। আমরা এখন কী করব? আমরা এ পেশা ছাড়তেও পারি না। ভয় লাগে, কারণ এটাই যে আমাদের উপার্জনের পথ। কেউ কেউ অবশ্য ছেড়েও দিচ্ছেন। কিছু চিকিৎসকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, তাঁরা তাঁদের পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।’
উপাচার্য মহাশয় সেদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ আছে। শিক্ষাব্যবস্থার বদল প্রয়োজন। কিন্তু এটা বদলাতে সবাই ভয় পায়। যেদিন আমরা এই ভয় থেকে মুক্ত হতে পারব, সেদিনই সত্যিকার পথ খুঁজে পাব।’
আমার মনে হয়, জীবনে সফল হওয়ার জন্য যেকোনো একটা বিষয় প্রয়োজন। কিন্তু মানব সম্প্রদায় হিসেবে আমরা বরাবরই আমাদের জীবন ও মনকে উদ্ভট পথে পরিচালিত করি। বেঁচে থাকার জন্য কিছু অর্থ উপার্জন করুন। দ্যাটস অ্যানাফ!
যাহোক, আমি শিক্ষা নিয়ে কথা বলছিলাম। বলছিলাম যে আমরা আসলে বাস করি কয়েক হাত ঘুরে আসা জ্ঞানের মধ্যে। বিষয়টি আর একটু পরিষ্কার করে বলা দরকার। যখন একটি পশু মারা যায়, সে আসলে মারাই যায়। পশুদের এমন কোনো প্রজন্ম নেই যারা তাদের জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সরবরাহ করতে পারে। কোনো পশুই বই লিখতে পারে না, যে বই বছরের পর বছর অন্য প্রাণীরা পড়তে পারে, কিন্তু মানুষ পারে। তাই মানুষের জ্ঞান আসলে ‘সেকেন্ডহ্যান্ড নলেজ!’
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে মারুফ ইসলাম

প্রতিভা দিয়েই সব হয় না : ম্যারি ব্যাররা

বিখ্যাত মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যারি ব্যাররা। ম্যারির জন্ম ১৯৬১ সালের ২৪ ডিসেম্বর। ২০১৪ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকাভুক্ত করে। ২০১৩ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ৩৫তম শক্তিশালী নারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ম্যারি ব্যাররা ২০১৪ সালের ৩ মে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই বক্তব্য দেন।
ম্যারি ব্যাররাউপস্থিত সব অভিভাবক, অতিথি আর সম্মানিত শিক্ষকদের ধন্যবাদ। আজকের অনুষ্ঠানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যারা, সেই ২০১৪ সালের স্নাতক শিক্ষার্থীদের আমার শুভেচ্ছা। এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমি থাকতে পেরে ভীষণ আনন্দিত।
আজ কেন জানি বারবার আমি আমার শিক্ষাজীবনে ফিরে যাচ্ছি। সমাবর্তনের সেই উত্তেজনা, আনন্দের কথা আমাকে এখন শিহরিত করছে। সেই দিন আমি যে প্রত্যয় আর স্বপ্ন দেখেছিলাম তা বারবার মনে পড়ছে। সেই সময়ের পৃথিবী এখন অনেক বদলে গেছে। এখন তো তোমরা একুশ শতকের স্নাতক। সমাজে তোমাদের বয়সের কিশোর আর তরুণদের সংখ্যাই বেশি। 
তোমাদের নিজেদের মধ্যে কিন্তু ভাবনার মিল কমই দেখা মেলে। যেমন ধরো, তোমাদের মধ্যে সবাই কিন্তু সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা মুঠোফোনের মধ্যে ডুবে থাকো না। নানা পরিসংখ্যান বলে, কিশোর আর তরুণদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের মাত্র একজন এই যন্ত্র-বন্ধুটিকে ছাড়া রাতে ঘুমোতে যাও। তোমরা সবাই ধনী নও, কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী প্রজন্মের সদস্য তোমরা। চিন্তা করে দেখো, আগের সময়ের পৃথিবীর মানুষের চেয়ে তোমরা কত বেশি সুযোগ-সুবিধা লাভ করো। তোমাদের ইন্টারনেট আছে, আছে আইফোন। 
তোমাদের আরেকটি কথা না বললেই নয়, তোমাদের এই প্রজন্মের বেশির ভাগ কিশোর আর তরুণই কিন্তু অমনোযোগী। হ্যাঁ, আমি তোমাদের অমনোযোগী বলছি। তোমরা কারও কথাই যেন শুনতে চাও না। আমি কিন্তু সবাইকে অমনোযোগী বলছি না, কেউ কেউ। এই যে শেষ তিন মিনিটে আমার কথা শুনতে শুনতে তোমাদের মধ্যে গুটি কয়েক নিজেকে খুদেবার্তা আর টুইট করা থেকে বিরত রাখতে পেরেছ। অন্যরা টুইট, স্ট্যাটাস আর টেক্সট নিয়ে ব্যস্ত।
আগের পৃথিবীর সবকিছু এখন বদলে গেলে, কিছু কিছু জিনিস কিন্তু এখনো আগের মতোই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তোমরা যে মানসিক দক্ষতা, গাণিতিক যুিক্ত, সমস্যা সমাধানের কৌশল, যোগাযোগ দক্ষতা, টিমওয়ার্ক নিয়ে জ্ঞান অর্জন করেছ তা কিন্তু অসাধারণ। ৩০ বছর আগে এগুলো ছিল সফলতার সূত্র। এখনো মানুষকে সফল হতে হলে এসব দক্ষতা প্রয়োজন। কিন্তু আমার চেয়েও এই সব তত্ত্বকথা তোমরা বেশি ভালো করে জানো, বোঝো। কারণ, আগে এসব গুণ সফলতার পথ নির্মাণ করত। আর এখন মানুষ এই সব দক্ষতা নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে।
ইন্টারনেটের কারণে তোমরা আগে থেকেই সব জানতে পারো। কিন্তু তার পরেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের দক্ষতা আর গুণ মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে। নিজেকে অন্যের চেয়ে দক্ষ করে তুলতে একাগ্রতার বিকল্প নেই। আমার সমাবর্তনের পর থেকে জীবনে অনেক কিছু শিখেছি। যা শিখেছি তার থেকে আধা ডজন নীতিকথা তোমাদের জানাতে চাই।
এক. যে কাজ একবার শুরু করেছ, তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হবে না। সফল হওয়ার ইচ্ছা আর পরিশ্রম দিয়ে সেই কাজ করে যাও। আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, স্কুল-কর্মস্থলে, পেশাজীবনে, খেলাধুলায় সব জায়গায় অনেক প্রতিভাবান লোকের দেখা মেলে। কিন্তু মনে রেখো, প্রতিভা দিয়েই সব হয় না। সফলতার জন্য তোমাদের প্রয়োজন প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম। সাফল্যের দরজায় জোরে ধাক্কা দাও। পরিশ্রম করো৷
যদি তুমি কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী হও, তাহলে তোমার একাগ্রতা আর পাগলামি তোমার দলের অন্যদের উৎসাহ জোগাবে। বড় কিছু অর্জনের জন্য যতটা সম্ভব পরিশ্রম করে যাও।
দুই. সব সময়ের জন্য সৎ থাকতে হবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে নিজেকে সৎভাবে প্রমাণিত করো৷ নিজের কাছে সততা সবচেয়ে বড় আত্মবিশ্বাস। কথা ভঙ্গ করবে না। তোমার গ্রাহকদের জন্য, পিতামাতার জন্য, কর্মীদের জন্য, পরিবারের জন্য, বন্ধুদের জন্য এবং নিজের জন্য, যেটা ঠিক সেটাই করবে সততার সঙ্গে।
তিন. বন্ধু তৈরি করো৷ মনে রেখো, সফলতা কখনো একা আসে না। একসময় তোমরা নিশ্চয়ই বড় বড় সাফল্য লাভ করবে। কিন্তু কখনোই একা একা তুমি কিছুই করতে পারবে না। বন্ধু তৈরি করো৷ সাফল্য সব সময় দলগত পরিশ্রমের সমষ্টিগত ফলাফল। তোমরা আগামীর দলনেতা। নেতৃত্বের জন্য তোমাদের অন্য মানুষের কাছ থেকে সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্য অর্জন করতে হবে। নিজের কথা বলার চেয়ে অন্যদের কথা শোনার অনন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে তোমার। সত্যি বলতে মানুষ তখনই তোমার প্রতি সহানুভূতি দেখাবে, যখন তুমি তাদের সহানুভূতি দেখাবে। জীবনের নানা প্রয়োজনীয় কাজের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে তোমাকে অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, বাড়াতে হবে বন্ধুর সংখ্যা।
চার. যেকোনো বাধা-বিঘ্নকে সামনে থেকে মোকাবিলা করতে হবে। বাড়ি কিংবা অফিসে যেখানেই তুমি কোনো সমস্যা দেখবে, তার সম্মুখীন হও। তোমার যা কিছু আছে তা নিয়েই সমস্যার সমাধান করো৷ আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, যেকোনো সমস্যা সমাধানে পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাও। মনে রেখো, সমস্যার সমাধান সামনে থেকেই করতে হয়। সমস্যাকে যতই অবজ্ঞা করবে, ততই তা বড় হয়ে উঠবে।
পাঁচ. অন্যের জন্য কিছু করো৷ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আর উদ্ভাবনী প্রযুক্তির এই সময়ে তোমাদের সামনে আছে অনেক সুযোগ। অনেক কিছু করে ফেলতে পারবে তোমরা। কিন্তু সবকিছুর আগে একটা কাজ করতে কখনোই ভুলবে না। নিজের মেধা দিয়ে অন্যের জন্য ভালো কিছু করবে সব সময়। আমি জানি, আজকের এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বেশ কজন স্পাইডারম্যান-ভক্ত আছে। স্পাইডারম্যান সিনেমার সেই উক্তি নিশ্চয়ই তোমাদের মনে আছে? ‘অধিক ক্ষমতা অন্যের প্রতি তোমার বড় দায়িত্ব তৈরি করে।’ 
সর্বশেষ, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো৷ আমি এই বিশেষ দিনে তোমার বন্ধু, পরিবার এবং নিজের ওপর বিশ্বাস রাখার কথা বলছি। নিজের বন্ধু আর পরিবারকে সব সময় কাছে রাখবে। আমি তোমাদের পরিবার আর বন্ধু কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলে বোঝাতে পারব না। তারাই তোমার পথ চলাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারে। ভালো সময়গুলো তাদের সঙ্গে উদ্যাপন করো৷ আর কঠিন সময়গুলোতে পরিবার আর বন্ধুদের পরামর্শ নাও। নিজের বিশ্বাসের ওপর আস্থা রাখো।
আমি আজকের বক্তৃতার প্রথম দিকে তোমাদের ধনী, সৌভাগ্যবান প্রজন্ম বলে হালকা হেয় করলেও একটা কথা কিন্তু এখনো বলিনি। তোমরা পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উদ্ভাবনী এবং প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ একটি প্রজন্ম। তোমাদের হাতের মুঠোয় এখন সমাজ বদলের নানা অনুষঙ্গ। তোমাদের সামান্য চিন্তায় এখন বদলে যায় সমাজ। সামনে যে সুযোগ আসবে, সেটাই খপ করে ধরে ফেলবে। ক্যারিয়ারের শুরুতে যা করার সুযোগ পাবে তা-ই করবে। সব নতুন অভিজ্ঞতা তোমার দক্ষতাকে বিকশিত করবে, দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দেবে। যেকোনো কাজকে ভালোবাসো। কাজ উপভোগ করো। অভিজ্ঞতাই তোমার সাফল্যের গতি নির্ধারণ করে দেবে। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে মনোযোগী হও। তোমাদের সবাইকে আমার অভিনন্দন। আমি তোমাদের প্রত্যেককে নিয়ে আজ আনন্দিত ও গর্বিত। সবাইকে ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্র: ওয়েবসাইট, ভাষান্তরে জাহিদ হোসাইন খান

আজ যা কল্পনা তা আগামীর বাস্তবতা : সুন্দর পিচাই

সুন্দর পিচাইসুন্দর পিচাই গুগল–এর নতুন সিইও। জন্ম ১৯৭২ সালের ১২ জুলাই ভারতের চেন্নাইতে। আইআইটি থেকে পড়াশোনা শেষে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। তিনি অ্যানড্রয়েড মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম, ক্রোম ব্রাউজারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমি সব সময় উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ভক্ত। সাধারণ মানুষের জন্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ করার আনন্দ অন্য রকম হয়। গুগল ইনকরপোরেটেডের মাধ্যমে আমরা এ কাজটি সারা বিশ্বে করে যাচ্ছি। গুগলের মূল আদর্শই হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছানো।
আমার জন্ম চেন্নাইতে। আমি আইআইটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে আসি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার অন্যতম আগ্রহ ছিল কম্পিউটার। গুগলে কাজের সুযোগ পেয়ে আমি সেই আগ্রহের জায়গায় কাজ করার অনেক সুযোগ পেয়েছি। আমি ছোটবেলায় সংখ্যা মনে রাখতে পারতাম অনেক। অনেক ফোন নম্বর মুখস্থ করতে পারতাম। আমার চাচা মাঝেমধ্যেই আমাকে ফোন দিয়ে হারানো অনেক নম্বর জিজ্ঞেস করতেন। ২০০৪ সালে আমি গুগল অফিস গুগলপ্লেক্সে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে যাই। সেদিন গুগল জিমেইল চালু করে। এপ্রিলের প্রথম দিন দেখে আমি ভেবেছিল জিমেইল আসলে গুগলের কোনো রসিকতা হবে।
তরুণদের ওপর আমার ভরসা অনেক বেশি। আমি নিজেও তরুণ বয়সে অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম। এখনকার তরুণদের সাহস দেখে আমি শক্তি পাই। আমার মনে হয় আগামীর ই-কমার্স দুনিয়ার পুরোটার নেতৃত্ব দেবে তরুণেরা।
প্রযুক্তির ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। টেলিভিশন থেকে শুরু করে মুঠোফোন—সবারই মন্দ দিক আছে। মন্দ দিক এড়িয়ে প্রযুক্তিকে উন্নয়নের জন্য কাজে লাগানোই হবে কাজের কাজ। এখন আমাদের হাতের মুঠোয় দুনিয়া চলে আসছে। স্মার্টফোন আসলে একেকটি কম্পিউটারের কাজ করে, যা আমাদের পকেটে ঘুরছে সব সময়। প্রযুক্তি দিয়ে দুনিয়া বদলে দেওয়া সম্ভব এখন। মুঠোফোন আসার আগে আমি একসঙ্গে অনেক কাজ করতে পারতাম না। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন মিটিং আর ই-মেইল একসঙ্গে করতে পারছি আমরা। দুনিয়া সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়ছে। সেই হিসেবে প্রযুক্তির দক্ষতা আর সক্ষমতাও এগিয়ে চলছে। মানুষের বুদ্ধি আর প্রযুক্তির দক্ষতা যেন এখন একটা বড় আনন্দময় ভ্রমণ। আগামীকাল কী প্রযুক্তি আসবে, তা মানুষ বুদ্ধি দিয়ে আগেই জেনে নিচ্ছে। আজ যা কল্পনা তা আগামীর বাস্তবতা।
গুগলে আমি একটাই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। মানুষকে আরও বেশি প্রযুক্তি সংযোগ আর কানেক্টিভিটিতে আনা যায় তা নিয়ে ভাবি আমি। মুঠোফোন দিয়ে মানুষকে ইন্টারনেটে বেশি মাত্রায় সংযোগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির মাধ্যমে বদল আনতে সব সময় আমরা ভাবি। চালকবিহীন গাড়ি থেকে শুরু করে গুগল গ্লাস, এ সবের মাধ্যমে প্রতিদিনকার জীবনে প্রযুক্তির ছোঁয়া দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা।
আমাদের সামনে সমস্যা কী আমরা জানি, সমস্যা কীভাবে সমাধান করতে হয় সেটাও আমরা বুঝি। সাধারণ মানুষের নানা সমস্যার সমাধান করা বেশ কষ্টকর হলেও প্রযুক্তিবিদেরা সমস্যার সমাধান নিয়েই সময় কাটান। ভারতসহ পৃথিবীর অনেক জায়গায় এখনো ইন্টারনেট সবার জন্য সহজলভ্য হয়নি। এই বিশাল সংখ্যার মানুষকে কানেক্টিভিটির আওতায় আনলে সারা পৃথিবীরই সার্বিক উন্নয়ন হবে।
এই পৃথিবীতে চার শ কোটির বেশি মানুষ এখনো ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে আছে। আমরা এ অবস্থা বদলাতে চাই। আমরা সবাইকে ইন্টারনেটের ছাতার নিচে আনার জন্য ‘লুন’ নামের বিশাল একটি কর্মসূচি নিয়েছি। প্রায় দুই বছর আগে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছি। তখন এই বেলুন তিন দিনের জন্য আকাশে উড়তে পারত, প্রযুক্তির দারুণ কৌশলে এই বেলুন এখন টানা ছয় মাস আকাশে ভেসে থ্রিজি সেবা দিতে পারছে।
তরুণ প্রকৌশলীদের জন্য আমার পরামর্শ থাকবে সব সময় বেশি চিন্তা না করা। আমি নিজে প্রকৌশলী হিসেবে সবাইকে যার যা করতে ভালো লাগে, তাই করার উৎসাহ দিই। আগ্রহের জায়গায় কাজ করলে অনেক আনন্দ পাওয়া যায়। বড় মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে তা কাজে লাগানো উচিত। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। তোমার যদি কোনো কিছুর মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়, তা নিয়েই কাজ করা উচিত। আমি সারা জীবনই এই আদর্শে কাজ করে যাচ্ছি।

সূত্র: ইন্টারনেট। দ্য ভার্জ, এনডিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে ভাষান্তর করেছেন জাহিদ হোসাইন খান

ক্রিকেটই আমার জীবন : শচীন টেন্ডুলকার

সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার। ২০১১ সালের বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলের সদস্য। ১৯৮৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। জন্ম ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করেছেন ১০০টি সেঞ্চুরি। খেলেছেন ২০০টি টেস্ট। টেস্টে ৫১টি সেঞ্চুরিসহ ১৫ হাজার ৯২১ রান এবং ৪৬৩টি ওয়ানডে ক্রিকেটে ৪৯টি সেঞ্চুরিসহ ১৮ হাজার ৪২৬ রানের মালিক তিনি।
শচীন টেন্ডুলকারশুধু ভারতের হয়ে খেলা গত ২২ বছর ধরে নয়, তারও অনেক আগে থেকেই ক্রিকেট আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ১১ বছর বয়সে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে ক্রিকেট আমি সিরিয়াসলি খেলব, তখন থেকে ক্রিকেটই আমার জগৎ। এর আগেও আমি ক্রিকেট খেলতাম, কিন্তু সেটা ছিল আমার পড়শি বন্ধুদের সঙ্গে মজা করে টেনিস বল দিয়ে খেলা—এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু যে মুহূর্ত থেকে আমি ঠিক করলাম, আমি ক্রিকেট খেলব এবং আমার লক্ষ্য হবে ভারতের হয়ে খেলা; সে মুহূর্ত থেকে আমার জীবনে যা ঘটেছে, তা ক্রিকেটকে ক্রিকেটকে কেন্দ্র করেই ঘটেছে। আমার জীবনের সব দায়িত্ব, সব চাপ সামাল দিয়েছে আমার বড় ভাই অজিত এবং বিয়ের পরে আমার স্ত্রী অঞ্জলি। এ কথা বললে ভুল হবে না, আমার জীবনের মঞ্চে সামনে ছিল শুধুই ক্রিকেট, বাকি সবই পেছনে। 
আমি যখন স্কুলে পড়তাম, অনেকবারই আমার ইচ্ছা হয়েছে প্র্যাকটিসে না গিয়ে আমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলি। তাদের সঙ্গে ভেলপুরি, পানিপুরি খেয়ে সময় কাটাই; সিনেমা দেখি, টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলি কিংবা বাসার সামনে ছোটাছুটি করি—১২ বছর বয়সী একটি ছেলের এসবই তো করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমার কোচ রমাকান্ত আচরেকার তাঁর স্কুটার নিয়ে শিবাজি পার্ক থেকে চলে আসতেন এবং আমাকে নিয়ে যেতেন। তিনি আমাকে ক্রিকেট খেলিয়েই ছাড়তেন। আমি অনেকবার লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু প্রতিবারই তিনি আমাকে খুঁজে বের করতেন। এখন যখন আমি পেছনে ফিরে তাকাই এবং সেসব দিনের কথা ভাবি, যখন আমি ক্রিকেট খেলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াতাম, আমি খুবই আনন্দ পাই এই ভেবে যে এসব আমার জীবনে হয়েছে। এ ঘটনাগুলো না ঘটলে জীবনে আমি অনেক কিছুই পেতাম না। ক্রিকেটে আমার সাফল্যের পেছনে আমার বড় ভাই অজিত এবং কোচ রমাকান্ত আচরেকারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
আমি ভারতের ক্রিকেট ক্যাপ প্রথম মাথায় দিই ১৯৮৯ সালে, পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের আগের প্রস্তুতি ম্যাচে। সেটা ছিল আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর অন্যতম। ভারতীয় দলের টুপি, সোয়েটার, জার্সি—সবকিছুই আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি সব সময় মাঠে নেমেছি বড় রান করার জন্য। আমার সব ব্যক্তিগত রেকর্ড, মানুষ আমার যেসব বড় রানের কথা স্মরণ করে—সবকিছুই এসেছে ভারতের হয়ে খেলতে গিয়ে। আমি ভালো বা খারাপ, যা-ই খেলি না কেন, ভারতের হয়ে খেলতে গিয়েই এসব এসেছে এবং সব সময়ই আমার লক্ষ্য ছিল একটাই—মাঠে নেমে ম্যাচ জিতে আসা। এটা করতে গিয়ে আমি যা অর্জন করেছি কিংবা যা অর্জন করতে পারিনি, এসব ছিল আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমি আমার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি সব সময়। আমি বিশ্বাস করি, একজন খেলোয়াড়ের জন্য ম্যাচের আগের প্রস্তুতি সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করে, এটা নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগায় যে আমি আমার সেরাটা দিতে পারব। কিন্তু ম্যাচে কী হবে, সেটা একমাত্র সর্বশক্তিমানই জানেন, আমরা সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। কখনো ম্যাচের ফল আমাদের পক্ষে যায়, কখনো বিপক্ষে—আমরা সব সময় মাঠে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করি।
স্বপ্ন দেখা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্নের পেছনে শ্রম দেওয়া। আমরা স্বপ্ন দেখি নিদ্রায়, কিন্তু কাজ করি জেগে থেকে; জেগে থাকাটাও আমাদের জীবনে সমান গুরুত্ববহ। আমি যেভাবে নিজেকে ম্যাচের জন্য প্রস্তুত করি, তাতে প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমার হাতে থাকে। নিজের প্রস্তুতির কাজটা আমি নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। মাঠে খেলতে নেমে কোনো খেলোয়াড়ই এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে না যে আমি আজকে সেঞ্চুরি করব বা পাঁচ উইকেট তুলে নেব। কিন্তু সম্পূর্ণ প্রস্তুতির গ্যারান্টি একজন খেলোয়াড় দিতে পারে, কারণ এটা তার নিয়ন্ত্রণের আওতায়। একজন খেলোয়াড়ের উচিত নিজের নিয়ন্ত্রণের আওতায় যে জিনিসগুলো আছে, সে ব্যাপারগুলোতে সময় দেওয়া। আর যে ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেগুলোকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া। আমি যখন জানি যে আমি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি এবং এর চেয়ে আর ভালো কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তখন আমি নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাই। খেলায় আমি চেষ্টা করি নিজের চিন্তাকে যতটা সম্ভব শূন্য রাখতে, এতে করে আমি যেকোনো বলকে তার মতো করেই খেলতে পারি। এটা আমার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আসে।
এটা ভাবতে আমার খুবই ভালো লাগে যে মানুষ আমার খেলাকে ভালোবেসেছে, আমাকে সমর্থন দিয়েছে, আমার জন্য প্রার্থনা করেছে। এমন অনেক মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, যারা আমার মঙ্গল কামনায় কয়েক সপ্তাহ ধরে উপবাস পালন করেছে। আমি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই এ সবকিছুর জন্য এবং প্রার্থনা করি, সবকিছু যেন এভাবেই চলতে থাকে। যখন কেউ কোনো কাজে নিজের মনপ্রাণ ঢেলে দেয় এবং লাখ লাখ মানুষ তার সেই কাজের প্রশংসা করে—এটা সেই মানুষকে অসীম আনন্দ এনে দেয়, তার প্রতি মুহূর্তের শ্রমকে সার্থক করে তোলে। আমি সেই মানুষ হতে পেরেছি, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

সূত্র: ডেইলি মোশন ডট কম। অর্ণব গোস্বামীকে দেওয়া শচীন টেন্ডুলকারের সাক্ষাৎকার অবলম্বনে লিখেছেন মনীষ দাশ

আমি কখনো হাল ছাড়ি না: মারিয়া শারাপোভা

মারিয়া শারাপোভা বিশ্বের অন্যতম আলোচিত টেনিস খেলোয়াড়। শারাপোভার জন্ম রাশিয়ায়, ১৯৮৭ সালের ১৯ এপ্রিল। এ যাবৎ তিনি টেনিসের পাঁচটি গ্র্যান্ড স্লাম জয় করেছেন। ২০০৭ সাল থেকে মারিয়া জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করছেন।
মারিয়া শারাপোভা১৭ বছর বয়সে আমি উইম্বলডন জয় করি। এর কয়েক বছরের মধ্যেই মারাত্মকভাবে কাঁধের ইনজুরিতে পড়ে আমার খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আমার সামনে অনেক কারণ ছিল, যার জন্য টেনিস খেলাই ছেড়ে দেওয়ার কথা তুলেছিল অনেকে। ইচ্ছা করলেই তখন খেলা ছেড়ে দিতে পারতাম, কিন্তু হাল না ছেড়ে আবার কোর্টে নামার সাহস করি।
সত্যিকার অর্থে, আমার বেড়ে ওঠা ছিল ছাই থেকে। আবর্জনা থেকে আমার পরিবার মাথা তুলে দাঁড়ায়। আমার শিকড় কোথায়, সেটা আমি জানি। আমার শুরুর সেই কষ্টের দিনগুলো আমি কখনোই ভুলতে পারব না। আমার বাবা-মা দুজনেই বেলারুশ থেকে আসেন। আমি যখন মায়ের পেটে, তখন চেরনোবিল দুর্যোগ ঘটে। বাবা আর মায়ের কাজ চলে যায়। তাঁদের বাকি জীবনটা অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গেছে। আমি তাঁদের মেয়ে। বাবা চার বছর বয়সে আমার হাতে টেনিস র্যাকেট তুলে দেন। বাবাই ছিলেন আমার প্রথম কোচ। স্কুলে পড়াশোনা আর বাড়ির কাজ শেষ করে প্রতিদিন টেনিস অনুশীলনে নামতাম।
আমি কোনো কিছু ধরলে তা ছাড়ি না। আমার বিখ্যাত কোনো বন্ধু ছিল না, যার মাধ্যমে আমি খ্যাতি অর্জন করতে পারি। কিংবা আমি ফ্যাশন মডেল নই, যাকে কোনো লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন বিখ্যাত করেছে। মূল কথা হচ্ছে, টেনিসই আমাকে সব দিয়েছে। ইনজুরিতে থাকার সময় যখন ম্যাগাজিন আর পত্রিকায় আমার ছবি দেখতাম, তখন ঠিক থাকতে পারতাম না। হাসপাতালে বসে কোর্টে দৌড়ানোর শব্দ পেতাম। আর দৌড়াব বলেই টেনিস কোর্টে ফিরে আসি।
আমি সব সময় মাঠে থাকতে চাই। প্রতিদিন। জয়-পরাজয় নিয়ে ভাবি না। মাঠে থাকাই সব। খেলা শেষে ঘেমে একাকার হয়ে বাড়ি ফিরতে চাই।
আমার বেড়ে ওঠা ছিল রাশিয়ার সোচি শহরে। যুক্তরাষ্ট্রে সবাইকে সোচি নামের বানান করে বলতে হতো। কেউ জানত না সোচি মানচিত্রের কোথায়। এখন আমার জন্য অনেকেই মানচিত্রে সোচি শহরকে চেনে। এটা অনেক আনন্দের। আমি যখন রাশিয়ার পতাকা নিয়ে কোথাও দাঁড়াই, তখন আমার চেয়ে গর্বিত আর কে হয় বলুন?
খেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এক টেনিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিলাম। যার জন্য মায়ের সঙ্গে প্রায় দুই বছর দেখা হয়নি। তখন আমাদের মুঠোফোন ছিল না, কোনো ই-মেইলও ছিল না। একটা কলম আর এক টুকরা কাগজই ছিল আমার সব। মাকে চিঠি লিখতাম। চিঠি যখন মায়ের কাছে যেত, তখন আমার যে অনুভূতি হতো, তা এখনো শিহরিত করে।
টেনিস খেলার একাডেমিতে অন্য মেয়েরা আমাকে নিয়ে হাসত। বেশি ছোট ছিলাম বলে র্যাগিংয়ের শিকার হতাম। আমাকে টিজ করা হতো। তখন আমি হতাশ হয়ে একা একা কাঁদতাম, কিন্তু আমার লক্ষ্য আমি জানতাম। রেগে দেশে ফিরে গেলে আমি হয়তো আজকের আমি হতাম না। সব সময় আশাবাদী হয়ে থাকলে বিপদে পড়লেও নিজেকে নিজে উদ্ধার করা যায়। কষ্ট করে লেগে থাকতে হয় স্বপ্নের পেছনে।
২০০৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে উইম্বলডন জেতা ছিল আমার জন্য বিস্ময়। এটা স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। কখনোই চিন্তা করিনি মাত্র দুই সপ্তাহে পৃথিবীর সেরা সব টেনিস খেলোয়াড়কে হারিয়ে দেব! ফাইনালে আমি সেরেনা উইলিয়ামসকে হারিয়ে দিই। আমি কতটা দুর্ধর্ষ টেনিস খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিলাম, তা ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। কোনো দিকে মন না দিয়ে টেনিস বলেই আঘাতের পর আঘাত করে গিয়েছি। ফলে ফাইনালে আমার হাতেই ছিল সেরার পদকটি।
বেঁচে থাকার জন্য আমি টেনিস বলকে আঘাত করি, পরিশ্রম করি। আমি সব সময় সবার কাছ থেকে শেখার আগ্রহ নিয়ে বসে থাকি। বাবা আর মায়ের কাছ থেকেই আমি কৌতূহলী হয়ে ওঠার নেশাটি পেয়েছি। আমার কাছে সবচেয়ে বড় আর গুরুত্বের বিষয় হলো, প্রথমে ভালো মানুষ হওয়া, তারপর পেশাদার ক্রীড়াবিদ হতে হবে। এটা সত্যি অনন্য এক চ্যালেঞ্জ।
বেঁচে থাকার জন্য বন্ধুর বিকল্প নেই। আমি সুযোগ পেলেই বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যাই, গান গাই। টেনিস নিয়ে পড়ে থাকলেও পরিবারকে সময় দিই। যখন খুব হতাশায় ভুগি, তখন নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিই। নেইলপলিশ হাতে গ্র্যান্ড স্লামের ট্রফিগুলো তোলার স্মৃতি বারবার মনে করে নিজেকে সাহস দিই। আর হতাশার মাত্রা চরমে উঠলে গলা ছেড়ে গান গাই। প্রতিদিন সকালে আমি গান শুনে বাড়ি থেকে বের হই। আমার দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো মায়ের হাতের রান্না। মায়ের হাতের বৈচিত্র্যময় রান্নার জন্য বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে আমার। আমি সময় পেলেই বইয়ের পাতায় হারিয়ে যাই। একই বই কয়েকবার পড়ার বাতিক আছে আমার।
আমাকে কেউ কেউ ‘সুগারপোভা’ নামে ডাকে। অনেক ছোটবেলা থেকে আমি চকলেটের ভক্ত। আমার দাঁতে সব সময় চিনি লেগে থাকত। আমি চাইতাম বড় হয়ে আমি চকলেটের দোকান দেব। বড় হয়ে ব্যবসায়ী হব। সত্যি সত্যি টেনিস খেলার ক্যারিয়ার শেষ করে ব্যবসা করতে নামব।
মানুষের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা সে নিজেই। নিজেকে সাফল্যের চূড়ায় দেখতে চাইলে মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। যখন যা করো, তা-ই উপভোগ করো। বাড়িতে থাকলে টিভি দেখো, সিনেমা উপভোগ করো। হাসো। কিন্তু যখন কাজ করবে, তখন তাকে উপভোগ করো। নিজের প্রতিভা আর বুদ্ধি দিয়ে কঠিন সব কাজকে আয়ত্তে আনাই সফল ব্যক্তিদের কাজ। নিজের জীবনকে নিজেকেই আকর্ষণীয় করে তুলতে হয়। গণ্ডির মধ্যে না থেকে মাঝেমধ্যে পাগলামি করো। পাগলামি করা শেখো। সামান্য কিছুতেই হাসতে শেখো। হাসিই সবচেয়ে বড় ওষুধ। ঝুঁকি নিতে শেখো। দাঁতে পোকা ধরার ঝুঁকি থাকলেও মাঝেমধ্যে চকলেট খাও। নিজেকে নিয়ে খুশি থাকো!
কিশোর বয়সে যারা টেনিস খেলতে চায়, তাদের জন্য আমার পরামর্শ, লেগে থাকতে হবে। পড়তে হবে, জানতে হবে, খেলতে হবে। সবকিছুর জন্য চাই কঠিন অনুশীলন। ব্যর্থ হলেও লেগে থাকতেই হবে। সফল হলেও লেগে থাকতে হবে।
তথ্যসূত্র: টেলিগ্রাফকে দেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে লিখেছেন
জাহিদ হোসাইন খান