এখানে দাঁড়িয়ে আমি কতটা রোমাঞ্চিত, তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। আক্ষরিক অর্থেই জীবনে দ্বিতীয়বার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসেছি। অথচ বাড়ি ফিরব একটা ডক্টরেট ডিগ্রি (সমাবর্তনেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে দিয়েছে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব হিউমেন লেটারস’) নিয়ে, ভাবা যায়!
‘ড. রজার’। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত বিজয়!
এই পোশাকে আমি একেবারেই অভ্যস্ত নই। ডার্টমাউথে তোমরা প্রতিদিনই এসব পরে আসো নাকি! ভালো কথা, মনে করিয়ে দিই, জীবনের ৩৫টা বছর প্রায় পুরোটা সময়ই আমি শর্টস পরে কাটিয়েছি।
১৬ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে পুরোদস্তুর টেনিস খেলা শুরু করি। কলেজে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে হ্যাঁ, সম্প্রতি গ্র্যাজুয়েট হয়েছি। আমি গ্র্যাজুয়েট হয়েছি টেনিসে। জানি, শব্দটা আদতে ‘অবসর’। ‘রজার ফেদেরার টেনিস থেকে অবসর নিয়েছেন।’ অবসর...জঘন্য একটা শব্দ। আজ তোমাদের তো কেউ বলছে না, তোমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘অবসর’ নিচ্ছ!
স্নাতকেরা, তোমাদের ব্যথা আমি বুঝি। লোকে যখন বলে, ‘তা সামনের জীবন নিয়ে তোমার পরিকল্পনা কী, শুনি?’ তখন কেমন লাগে জানি। এই প্রশ্ন আমিও শুনি। ‘তুমি তো এখন আর পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় নও। আজকাল করো কী?’
উত্তর হলো, আমি জানি না এবং এই না জানায় কোনো দোষ নেই।
কীভাবে সময় কাটাই? প্রথমত, আমি একজন বাবা। বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাই? অনলাইনে অচেনা লোকদের সঙ্গে দাবা খেলি? ঘর পরিষ্কার করিনা। সত্য হলো, আমি আমার টেনিস গ্র্যাজুয়েট–জীবনটা উপভোগ করছি। আমি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি ২০২২ সালে। তোমরা ২০২৪। অতএব জীবনের রূপান্তরের এই সময়টা নিয়ে কিছু পরামর্শ তো দিতেই পারি।
‘অনায়াসে’ বলে কিছু নেই
মানুষ আমাকে নিয়ে বলে, কী অনায়াসেই না লোকটা খেলে। কিন্তু সত্যিটা হলো, কাজটাকে ‘অনায়াস’ দেখানোর জন্য আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। বছরের পর বছর আমি আর্তচিৎকার করেছি, খেঁকিয়ে উঠেছি, র্যাকেট ছুড়ে ফেলেছি...তারপর মাথা ঠান্ডা রাখতে শিখেছি।
সমাবর্তনেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে দিয়েছে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব হিউমেন লেটারস’ছবি: এএফপি
আত্মোপলব্ধিটা এসেছিল ক্যারিয়ারের একদম শুরুর দিকেই। যখন ইতালীয় এক প্রতিপক্ষ বলেছিল, ‘প্রথম দুই ঘণ্টা রজার থাকবে চালকের আসনে। তারপরই পাশার দান উল্টে যাবে।’
তার কথা শুনে শুরুতে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। পরে বুঝেছি, এ কথার মানে কী। প্রথম দুই ঘণ্টা ভালো খেলতে সবাই পারে। শুরুতে সবাই-ই ফিট থাকে, ক্ষিপ্র থাকে। মাথা পরিষ্কার থাকে। কিন্তু এরপরই একসময় পা টলমল করে। ভাবনা এলোমেলো হয়ে আসে, সংযম হারিয়ে যায়।
তাই আমি আরও কঠোর প্রশিক্ষণ শুরু করি। আর বুঝতে পারি, অনায়াসে জিততে পারাটাই সবচেয়ে বড় অর্জন।
গা গরম করার সময়, টুর্নামেন্ট চলার সময় খুব ‘সহজ’ দেখায় বলে আমার সুনাম আছে। অথচ এর পেছনে যে কত কঠোর প্রশিক্ষণ আছে, লোকে ভাবতেও পারবে না। সেই পরিশ্রমটা কেউ দেখে না।
শুধুই একটা পয়েন্ট
কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও তুমি হেরে যেতেই পারো। আমি হেরেছি।
টেনিস বড় নিষ্ঠুর। প্রতিটি টুর্নামেন্ট একইভাবে শেষ হয়। একজন ট্রফি জেতে। অন্যরা প্লেনে করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ভাবে, ‘ইশ্! এমন একটা শট কীভাবে মিস করলাম!’
ধরো, আজ তোমাদের সঙ্গেও যদি এমন হতো? যদি কেবল একজনের হাতে ডিগ্রি তুলে দিয়ে বলা হতো, ‘সবাই করতালি দাও। যে স্নাতক হলে, তোমাকে অভিনন্দন। অন্যদের জন্য শুভকামনা।’ কেমন লাগত বলো?
এ কারণেই না হারার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছি, কিন্তু হেরেছি। আমার জন্য সবচেয়ে বড় পরাজয়ের মুহূর্ত ছিল ২০০৮ সালের উইম্বলডনের ফাইনাল। আমি বনাম (রাফায়েল) নাদাল। অনেকে বলে, ওটাই টেনিস ইতিহাসের সেরা ম্যাচ। রাফার প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই বলছি, খেলাটা আরও অনেক অনেক রোমাঞ্চপূর্ণ হতো, যদি আমি জিততাম।
টেনিসে নিখুঁত খেলা অসম্ভব। আমি ক্যারিয়ারে ১ হাজার ৫২৬টি ম্যাচ খেলেছি। ৮০ শতাংশ ম্যাচে জিতেছি। অথচ কত শতাংশ পয়েন্ট পেয়েছি বলো তো? মাত্র ৫৪ শতাংশ।
কেন বলছি এসব কথা? যখন তুমি একটা পয়েন্টের জন্য খেলো, তখন ওই পয়েন্টই তোমার জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন পয়েন্টটা পেছনে ফেলে আসো, তখন সেটা শুধুই একটা ‘পয়েন্ট’। আর কিচ্ছু না।
জীবনে যে খেলাই খেলো না কেন, কখনো না কখনো তুমি হারবে। একটা পয়েন্ট হারাবে, একটা ম্যাচ হারাবে, একটা মৌসুম হারাবে, একটা চাকরি হারাবে...অনেকটা রোলারকোস্টার রাইডের মতো। যেখানে অনেক ওঠানামা। পৃথিবীর সেরা মানুষেরা কিন্তু এ কারণে সেরা নন যে তাঁরা প্রতিটি পয়েন্ট জেতেন। বরং তাঁরা জানেন, একটা পয়েন্ট হারালে কীভাবে সামাল দিয়ে আবার একটা পয়েন্ট জিততে হয়। (সংক্ষেপিত)
সূত্র: ডার্টমাউথের ওয়েবসাইট